কী হিংসে হয়, আমার মত হতে চাও?
বাংলার গ্রাম-গঞ্জের বেশ পুরনো প্রবাদ, ‘রাজায় কইছে… ভাই আনন্দের আর সীমা নাই’-এ এক অদ্ভুত প্রবণতা আমার স্বদেশী মানুষের।
চিপসের প্যাকেট, দাম দিয়ে কেনা পানির বোতল, ফল-মূলের খোসা যেখানে ইচ্ছা ফেলতে থাকবেন।
ধারণ ক্ষমতার অধিক এই ছোট্ট শহরে যে যেভাবে ইচ্ছা স্বাধীনতা ভোগ করবেন। আর হঠাৎ কোথাকার কোন ভিনদেশী জরিপে বলেছে, ঢাকা বিশ্বের ২য় নিকৃষ্ট বাসযোগ্য শহর, অমনি নিজেকে যেমন ইচ্ছা গালি দিতে শুরু করেছেন।
আমার এক বন্ধু বলতেন, ঢাকা হচ্ছে ‘সিটি অব মাস্টার ব্রেটার্স’ আর এক বন্ধু ইতিবাচক অর্থে বলতেন, ঢাকা হচ্ছে ‘লড়াকুদের শহর’। সবাই এখানে জীবন যুদ্ধে কঠর পরিশ্রম করছে।
তো যে যাই বলেন, এ শহরের প্রতি আমি আসক্ত। এ শহরের মানুষের বোকামি, চালাকি, মিথ্যা, সত্য, গ্রাম থেকে মাজায় বাঁশি গুজে এসে রিকশা চালানো মানুষগুলো।
গ্রাম থেকে এসে কিছু একটা করতে চাওয়া মানুষগুলো, আবার ঈদ বা উৎসব এলে এ শহর ছেড়ে প্রিয়জনের কাছে হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে থাকা মানুষগুলোর সবকিছুর মাঝে কোথায় যেনো এক প্রেমময়তা খুঁজে পাই।
আবার দেখেন, দুই দিন বিপ্লব-টিপ্লবের নামে ফেসবুক সয়লাব করে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলেনের সেই মানুষগুলোই একজন বাতিকগ্রস্থ বুড়ো মদ্যপের মুখের সংলাপ নিজের করে এখন ফেসবুকে ছেয়ে ফেলছেন, ‘কী হিংসে হয়, আমার মত হতে চাও?’ টাইপের পোস্টে।
আর দুদিন আগেই যখন শিক্ষার্থী স্কাউটরা ট্রাফিক সপ্তাহে, ট্রাফিক আইনের মহড়া দিচ্ছিলেন, তখন তাদের ঠেলে, ক্ষমতা প্রয়োগ করে, যেমন খুশি তেমন সেজে চলছিলো। তখন কেউ আর কিছু দেখেছেন না।
আপনি একটু ধীশক্তি দিয়ে বিবেচনা করলে দেখবেন, দুঃখই এখানে আমাদের দারুণ বিনোদন!
তাই তো শত সঙ্কটেও আমরা পৃথিবীর সুখী মানুষের তালিকায় নাম লেখাতে পারি। তাই তো, ওইসব পশ্চিমা, বিষন্নতার সর্বোচ্চ ওষুধ ক্রেতাদের বলি, তোমার ওইসব জরিপকে আমাদের গোনার টাইম নাই। আমাদের স্কুলের ছেলেমেয়েরা কিন্তু বলতে শিখেছে তোমরা কোন চ্যাটের বাল?
হুম?
কিছুদিন আগে, ডেইলি স্টারের একটি সেমিনারে এক সুইডিস সাংবাদিকের সঙ্গে দেখা।
বিকালের চায়ের আলাপে জানতে চাইলো, আচ্ছা তরিক বলো তো, এই যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তোমাদের লোকজন ট্রাফিক জ্যামে নির্বিকার বসে থাকে, কীভাবে মানুষ এত নির্বিকার থাকতে পারে এমন অর্থহীনতায়?
আমি তাকে বলেছিলাম, দেখো, তোমাদের পশ্চিমাদের সঙ্গে আমাদের এ অঞ্চলের মানুষদের একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। তা হচ্ছে, তোমরা তোমাদের শিক্ষা-দীক্ষায় ব্রেইনকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছো। ফলে তোমরা জীবনকে আত্নকেন্দ্রিক আর জটিল করে নিয়েছো। আর আমরা হার্ট বা হৃদয়কে গুরুত্ব দিয়েছি। এটা আমাদের মজ্জাগত। ফলে আমরা ভালোবাসতে জানি। দিন শেষে আমরা ক্ষমা করতে জানি। আর জানো তো, তুমি, আমি বা আমরা যখন মায়ের দেহের মধ্যে অস্তিত্বের দৈহিক আকৃতি পেতে থাকি, তখন প্রথমেই হার্টবিটই পাই। তাই, বন্ধু, হৃদয় দিয়ে দেখো। মনে রেখো, যাকে তুমি ভালোবাসবে, তাকে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখলে আর ভালোবাসতে পারবে না।
মানে তুমি যখন বিচার করছো, তখন ভালোবাসছো না।
আমি উল্টো ওই সুইডিসকে প্রশ্ন করলাম, এই যে তুমি বললে তুমি সুইডেনের একটি দ্বীপ গ্রাম থেকে উঠে আসছো। বলো তো, তোমার আরাধ্য কী? কেন এই বিশৃঙ্খল একটা শহর পর্যন্ত ছুটে এসেছো? কী চাও জীবনে? কী তোমাকে তাড়িয়ে নিয়ে এসেছে এতদুর?
মজার ব্যাপর হচ্ছে, ওই তরুণী এক কথায় উত্তর দিয়েছিল, ‘আমি জীবনে সুখী হতে চাই’।
আমি এবার একটু হেসেই বলেছিলাম, হুম! তোমাদের এত্ত এত্ত আছে, তারপরও তুমি সুখী হতে চাও! আর আমাদের এত্ত এত্ত কিছু নাই। তারপরও আমরা সুখী মানুষের কাতারে প্রথম সারির মানুষেরা!
আরও মজার হচ্ছে, মেয়েটি উচ্ছ্বসিত হয়ে হ্যান্ডশেক করলেন আর আমাকে পরের দিন সন্ধ্যায় চায়ের দাওয়াত দিয়ে দিলেন। ওর নাম সোফিয়া হিলখিস্ট।
তাই বন্ধুগণ! অতশত ভাইবেন না। পোস্ট দেন, কী আমার মত হতে চাও? হিংসে হয়? হা হা হা হা…
লেখক: তরিক রহমান, যুগান্তরের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান