নতুন এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে ফেসবুক। তরুণদের ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ। তরুণেরা চায় নতুনত্ব। ফেসবুক সে নতুনত্ব দিতে পারছে না। বরং অন্য প্ল্যাটফর্মের নকল করার অভিযোগ উঠছে। প্রযুক্তি যুগে তরুণদের ধরে রাখার মূল চ্যালেঞ্জ হল—নিত্য নতুন ফিচার চাই। নির্দিষ্ট সময় অন্তর প্রযুক্তি যদি নিজেকে নতুন ভাবে উপস্থাপন করতে না করতে পারে, ক্রমে সে হারিয়ে যাবে, এটাই নিয়তি। ফেসবুক কি সে পথেই হাঁটছে?
বিবিসি বলছে, ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গকে নিয়ে ‘দ্য সোশ্যাল নেটওয়ার্ক’ নামে ২০১০ সালে যে চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছিল, সেখানে মার্ক জাকারবার্গের চরিত্রের একটি সংলাপ ছিল-“স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা অনলাইনে যায়, কারণ তাদের বন্ধুরা অনলাইনে। তাই একজন সরে পড়লে, অন্যরাও সরে পড়ে। ” ফেসবুকের ব্যাপারে ওই বাক্যই ধীরে ধীরে সত্য প্রমাণিত হচ্ছে। অন্তত যুক্তরাষ্ট্রে।
সামাজিক যোগাযোগের জন্য ১৩ থেকে ১৭ বছরের কিশোর তরুণদের মধ্যে ফেসবুক এখন আর সবচেয়ে জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম নয়। তালিকার প্রথম তিনটির মধ্যেও ফেসবুক এখন আর নেই। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টার বলছে, তরুণরা প্রচণ্ডভাবে ইউটিউবে ঝুঁকে পড়ছে। ৮৫ শতাংশই বলছে, তারা ইউটিউব ব্যবহার করে। তারপরই রয়েছে ইনস্টাগ্রাম এবং স্ন্যাপচ্যাট।
যুক্তরাষ্ট্রে কিশোর তরুণদের মধ্যে ফেসবুকের অবস্থান এখন চতুর্থ। ৫১ শতাংশ তরুণ-তরুণী এখনও ফেসবুক ব্যবহার করছে। কিন্তু ২০১৫ সাল থেকে ফেসবুক ২০ শতাংশ ব্যবহারকারী হারিয়েছে। তবে এখনও অপেক্ষাকৃত অসচ্ছল পরিবারের সন্তানদের কাছে ফেসবুকের আবেদন রয়েছে।
মার্কিন প্রযুক্তি বিশ্লেষকেরা বলছেন, মা-বাবা, দাদা-দাদিদের সংখ্যা ফেসবুকে বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রেই তরুণদের কাছে দ্রুত অজনপ্রিয় হয়ে উঠছে সামাজিক যোগাযোগের সাইটটি। তথ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইমার্কেটার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানায়। ইমার্কেটার বলছে, ফেসবুক ও ফেসবুকের মালিকানাধীন ইনস্টাগ্রামের তুলনায় স্ন্যাপচ্যাট বেশি টানছে তরুণদের। তবে এখনো যুক্তরাষ্ট্রে ফেসবুক ব্যবহারকারী বাড়ছে। এর কারণ হচ্ছে, বয়স্ক ব্যক্তিরা ফেসবুক ব্যবহার করছেন বেশি। অথচ দীর্ঘ সময় ধরে ফেসবুকের মূল ব্যবহারকারী ছিলেন তরুণেরা। ইমার্কেটারের ওই প্রতিবেদনে তরুণদের আকর্ষণ ও ধরে রাখতে ফেসবুকের সমস্যার বিষয়টি উঠে এসেছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির পূর্বাভাস অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে এ বছর ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের ফেসবুক ব্যবহার ৫ দশমিক ৮ শতাংশ কমবে। ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রেও ফেসবুক ব্যবহার কমতে দেখা যাবে। ২০১৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত থাকবে। সব মিলিয়ে ২৫ বছরের কম বয়সী ২০ লাখ ব্যবহারকারী হারাবে ফেসবুক। এতে সুবিধা হবে স্ন্যাপচ্যাট ও ইনস্টাগ্রামের। ২০১৮ সালে স্ন্যাপচ্যাটে ১৯ লাখ ব্যবহারকারী বাড়বে। ইনস্টাগ্রামে বাড়বে ১৬ লাখ। বার্তা পাঠানোর পর তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুছে যাওয়ার প্ল্যাটফর্ম স্ন্যাপচ্যাটে ১২ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের আগ্রহ ইনস্টাগ্রামের চেয়ে বেশি থাকবে। তবে সব বয়সী ব্যবহারকারীদের কাছে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে ফেসবুকের মতো সমস্যায় পড়তে হবে স্ন্যাপচ্যাটকে।
ইমার্কেটারের বিশ্লেষক ডেবরা আহো উইলিয়ামসন বলেন, স্ন্যাপচ্যাটের নকশা বদল করে ব্যবহার সহজ করা হচ্ছে। সব বয়সী ব্যবহারকারী বাড়াতে এ পদক্ষেপ নেওয়া হলে তরুণদের আগ্রহ ধরে রাখার সমস্যায় পড়তে হবে স্ন্যাপচ্যাটকে। ফেসবুক বর্তমানে এ সমস্যায় আছে। যুক্তরাষ্ট্রে ফেসবুক এখনো সবচেয়ে জনপ্রিয় সাইট। ১৬ কোটি ৯৫ লাখ ব্যবহারকারী রয়েছে সেখানে।
ইমার্কেটারের পূর্বাভাস অনুযায়ী, এ বছর ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারী দাঁড়াবে ১০ কোটি ৪৭ লাখ আর স্ন্যাপচ্যাট ব্যবহারকারী দাঁড়াবে ৮ কোটি ৬৫ লাখে। গত বছরে ইমার্কেটার পূর্বাভাস দিয়েছিল, এ বছর প্রথমবারের মতো তরুণদের মধ্যে ফেসবুক ব্যবহারকারী কমতে দেখা যাবে।
ফেসবুক ব্যবহারকারীদের আস্থা ধরে রাখতে পারবে কি না, এ প্রশ্ন অবশ্য উঠছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। পিউ রিসার্চ সেন্টারের করা সমীক্ষা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের তরুণদের ফেসবুক আর আকর্ষণ করছে না। এত দিন তরুণদের বড় একটি অংশ ফেসবুকে মেতে থাকলেও এখন তারা ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাটের মতো প্ল্যাটফর্মে ঝুঁকে পড়েছে। পিউয়ের সমীক্ষা অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী তরুণদের ৫১ শতাংশ ফেসবুক ব্যবহার করছে। সে তুলনায় ইউটিউব ব্যবহারকারীর হার ৮৫ আর ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারী ৭২ শতাংশ। ৬৯ শতাংশ ব্যবহার করছে স্ন্যাপচ্যাট। এর আগে ২০১৪-১৫ সালে পিউয়ের সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল ৭১ শতাংশ তরুণ ফেসবুক ব্যবহার করছে। ওই সময় তরুণদের কাছে জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ফেসবুক ছিল শীর্ষে।
পিউ রিসার্চের গবেষক মনিকা অ্যান্ডারসন বলেন, মাত্র তিন বছর আগে তরুণদের কাছে সামাজিক যোগাযোগের যে ক্ষেত্রটি অগ্রগণ্য ছিল, এখনকার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। তরুণদের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক বাদেও অনেক ছড়িয়ে গেছে। তারা যেকোনো একটি প্ল্যাটফর্মে আটকে নেই। এখন তারা আগের চেয়ে বেশি ডিজিটাল উপায়ে সংযুক্ত। এবারের সমীক্ষায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ৯৫ শতাংশ তরুণের স্মার্টফোন আছে এবং ৪৫ শতাংশ সব সময় অনলাইনে থাকে। ৩১ শতাংশের মত হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগের প্রভাব ইতিবাচক। ২৪ শতাংশ এর প্রভাব নেতিবাচক বলে মনে করছে।
প্রায় ২০০ কোটির বেশি ব্যবহারকারী নিয়ে বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফেসবুক। কিন্তু কয়েকটি সমীক্ষা ও কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বলছেন, স্ন্যাপচ্যাট ও ফেসবুকের মালিকানাধীন ইনস্টাগ্রামের উঠে আসার কারণে তরুণেরা ফেসবুকে আগ্রহ হারাচ্ছে। এর আগে ই-মার্কেটার নামের আরেক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষায় একই রকম তথ্য উঠে এসেছিল।
এ ধরনের বিভিন্ন পরিসংখ্যান ফেসবুকের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান জিবিএইচ ইনসাইটের ড্যানিয়েল আইভস্ বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুক নিয়ে যে জল্পনা চলছিল, সর্বশেষ গবেষণায় তা সত্য বলে প্রমাণিত হচ্ছে। ফেসবুকের মালিক মার্ক জাকারবার্গ বলছেন, ২০১৭ সালের শেষ তিন মাসে ফেসবুকে কাটানোর সময় ৫ কোটি ঘণ্টা কমেছে। তিনি বলেন, ভিডিওর সংখ্যা কমানোর ফলে এটি হয়েছে।
তরুণদের সামাজিকমাধ্যম ব্যবহারের প্রবণতা নিয়ে গবেষণা করছেন যুক্তরাষ্ট্রের কানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুনজিন সো। কেন ফেসবুক ছেড়ে তরুণরা ইনস্টাগ্রাম এবং স্ন্যাপচ্যাটের দিকে ঝুঁকছে তার কতগুলো কারণ তিনি দিয়েছেন। ফেসবুকে বিভিন্ন বয়সীদের গতিবিধি, বিশেষ করে তাদের বাবা-মা এবং গুরুজনদের অবস্থানের কারণে অনেক তরুণ-তরুণী এই প্লাটফর্ম ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
তবে তরুণদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা হারালেও, সামগ্রিকভাবে এখনও ফেসবুক সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। ২০১৮ সালের প্রথম তিন মাসে নতুন চার কোটি ৮০ লাখ মানুষ প্রতিদিন ফেসবুকে ঢুকছে। এছাড়া তরুণদের অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম ইনস্টাগ্রামের মালিকানাও ফেসবুকের হাতে।