তথ্য-প্রযুক্তির বিপ্লবের পর চতুর্থ বিপ্লেবে খাপ খাওয়াতে হলে ডিজিটাল ও ভাষা অজ্ঞতা একটি বড় বৈষম্য। তাই এই দুই বাধা অতিক্রম করতে ইন্টারনেটের ভাষা হিসেবে ডট বাংলা বাস্তবায়ন গুরুত্বপূর্ণ। গ্রাম ও শহরপর্যায়ে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা ও প্রাপ্যতা ছাড়া চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে অংশ নেয়া যাবে না। সমান্তরালভাবেতৃতীয় শিল্প বিপ্লবের বৈষম্য দূর করতে হবে। সাইবার জগতের পাশাপাশি তথ্যের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) রাজধানী ঢাকার মোহাম্মাদপুরস্থ ওয়াই ডব্লিউসিএ ট্রেনিং সেন্টারে অনুষ্ঠিত দুই দিনের বাংলাদেশ স্কুল অব ইন্টারনেট গভর্নেন্স (বিডিসিগ-২০১৯) স্কুলের সমাপনী অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং বাংলাদেশ ইন্টারনেট গভর্নেন্স ফোরামের
চেয়ারপার্সন হাসানুল হক ইনু এমপি।
বিআইজিএফ সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মাদ আব্দুল হকের পরিচালনায় এসময় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ এনজিও নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কমিউনিকেশনের প্রধান নির্বাহী এএইচএম বজলুর রহমান, আইএসপিএবি সভাপতি এম এ হাকিম।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে হাসানুল হক ইনু বলেন, ২০০৯ সালে তৈরি ডিজিটাল তথ্য প্রযুক্তি আইন একটি ছাতার মতো কাজ করছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের পরেও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিক্ষিপ্তভাবে কাজ হলেও সমন্বিত কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একজন উপদেষ্টা দরকার।
তিনি বলেন, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও ব্যবসায়ীদের আগ্রহ থাকলেও ইন্টারনেট গভর্নেন্স নিয়ে রাজনীতিকদের ধারণা কম। ফলে ইন্টারনেট শাসনের ওপর আমেরিকার একক আধিপত্য রুখতে সময় লেগেছে। কিন্তু এই সম্পদের ব্যবস্থাপনা নিয়ে পিছিয়ে থেকে তৃতীয় বিপ্লবে এগুতো পারিনি। তাই নতুন নতুন আবিষ্কারের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারলে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে।
ইনু বলেন,কেবল কম্পিউটার ধরিয়ে দিলেই হলো না। সেই কম্পিউটার কোন ভাষায় কথা বলে তা গুরুত্বপূর্ণ। কেননা কম্পিউটার থেকে সেবা নিতে হবে। কৃষক পর্যায়ে ডিজিটাল সাক্ষর জ্ঞান নিশ্চিত করতে হবে।
এসময় ইন্টারনেট-কে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভূক্তির দাবি জানিয়ে ডিজিটাল সন্ত্রাস থেকে সকলকে রক্ষা করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান বাংলাদেশ ইন্টারনেট গভর্নেন্স ফোরামের চেয়ারপার্সন।
এই শতাব্দীতে এশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে অর্থনৈতিক শক্তিধর অঞ্চল হবে উল্লেখ করে হাসানুল হক ইনু বলেন,আমরা আজ জোর কদমে হেঁটে ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করছি। ভালো করতে হলে ডিজিটাল উন্নয়নের সমন্বিতউদ্যোগ দরকার। ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসতে হবে। তাদেরকে দেশের তথ্য-প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ করতে হবে।
বক্তব্যে শেষ পর্যায়ে অবিলম্বে ডিজিটাল কোর্ট, ডিজিটাল উকিল ও ডিজিটাল তদন্ত পুলিশ গঠনসহ ডিজিটালফরেনিসিক ল্যাব স্থাপনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। এগুলো ছাড়া ডিজিটালসিকিউরিটি অ্যাক্ট খোড়া বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, ই-বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রতারণা ঠেকাতে ওগ্রাহকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ডিজিটাল কমার্স আইন করতে হবে। তবে এর চেয়েও বড় বিষয় এখনো উপেক্ষিত রয়েছে। সেটা হলো তথ্য সুরক্ষা। ১৬ কোটি মানুষের তথ্য প্রবাহ আদান প্রদান হচ্ছে। ফেসবুক- টুইটার ও হোয়াটসঅ্যাপে বুঝে না বুঝে ডেটা শেয়ার করছি। তথ্য সুরক্ষায় একটি শক্ত আইন করতে হবে।
এর আগে দুই দিনের বাংলাদেশ স্কুল অব ইন্টারনেট গভর্নেন্স (বিডিসিগ-২০১৯) স্কুলের শেষ দিনে আইওটি’র ওপর আলোচনা করেন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের সহযোগী অধ্যাপক (সিএসই) কাজী হাসান রবিন।
তিনি বলেন, ইন্টারনেট সংযুক্ত ডিভাইসগুলোর মাধ্যে আন্তঃযোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে উপাত্ত সরবারহ করণ মুন্সিয়ানার ওপর নির্ভর করেই বাড়ন্ত হচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব।
সময়ের এই ধারায় এগিয়ে থাকতে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি কর্মক্ষমতা বাড়ানোর ওপর নজর দিতে হবে। ২০১৯ সালে আরএফআইডি’র মাধ্যমে আইওটি’র এই যাত্রা শুরু হলেও প্রতিনিয়ত এর বিস্তৃতি বাড়ছে। আর বহুল জনবসিত ও তারুণ্য শক্তি নির্ভরতার ফলে দেশে আইওটি ব্যবহারের দিগন্ত বিস্তৃত সম্ভাবনা রয়েছে। এই সম্ভাবনা কাজ ও ব্যবসায়ের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করবে। গড়ে উঠবে মিলিয়ন ডলারের বাজার। কৃষিকাজ, পশু প্রতিপালন, নগরীর আবর্জনা অপসারণ ছাড়াও দৈনন্দিন ক্ষেত্রে আইওটি ভিত্তিক সল্যুশনের ব্যবহারের মাধ্যমে বাড়বে উৎপাদন, কমবে খরচ। আর এআই সেবা উন্নয়নে সংগৃহিত তথ্যকে প্রজ্ঞা পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে।
অপরদিকে সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ক সেশনে ফাইবার অ্যাট হোম প্রধান নির্বাহী সুমন আহমেদ সাবির বলেন, প্রযুক্তি দুনিয়ায় সাইবার নিরাপত্তা লবেণেল মতো। এর গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। বিশ্বাসের অভাব থেকেই শুরু হয় নিরাপত্তার ঝুঁকি। তাই সাইবার নিরাপত্তা আর বিশ্বাস মুখোমুখি অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু যন্ত্রের ওপর বিশ্বাস রাখা যায় না। তাই এই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে প্রযুক্তি সচেতনতার মাধ্যমে।
তিনি বলেন, প্রতিটি ডাটার একটি সুনির্দিষ্ট ভ্যালু বা মূল্য রয়েছে। তাই এর নিরাপত্তায় নিরাপদ অবকাঠামো ও স্থাপনা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সাইবার আচরণ, মূল্যবোধ ও সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। অংশীজনদের নিয়ে এই বিষয়ে নীতি নির্ধারণ পর্যায়ে সুস্পষ্ট ধারণা পৌঁছে দিতে হবে। প্রত্যেককে নিজ নিজ
অবস্থান থেকে সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে কাজ করতে হবে। বৈশ্বিক কলাবরেশন বাড়াতে হবে। গত এক বছরে দেশে ঘটমান বিষয় পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে স্পর্শকাতর ডেটার প্রসেসিংয়ে আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড থেকে আমরা অনেকটা পিছিয়ে আছি।
এছাড়াও ডিজিটাল অর্থনীতির ওপর আলোচনা করেন এসএসএল ওয়্যারলেসের ই-কমার্স সেবা বিভাগের প্রধান এম নাওয়াট আশেকিন। ডোমেইন নেম সিস্টেম (ডিএনস) নিয়ে আলোচনা করেন আইক্যান ফেলো শায়লা শারমিন।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লব নিয়ে বাংলাদেশ সেন্টার ফর ৪আইআর ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ফেলো সৈয়দ তামজিদ উর রহমান এবং ভুয়া তথ্য ও প্রচারণা এবং ফেক নিউজের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেন আন্তর্জাতিক মিডিয়া কনসালটেন্ট জায়ান আল মাহমুদ।
সমাপনী অনুষ্ঠানে ১৭২ জন আবেদনকারীর মধ্যে প্রশিক্ষণ নেয়া নির্বাচিত ৪৫ জন ফেলোর হাতে সনদ তুলে দেয়া হয়।