বাংলাদেশ থেকে বিনা খরচে আগামী পাঁচ বছরে ৩ লাখ ৬১ হাজার ৪০০ দক্ষ কর্মী নেবে জাপান—এ খবর গত আগস্ট মাসের। এর মধ্যে চার মাস পার হয়ে গেছে। জাপান সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের এ নিয়ে চুক্তি হয়েছে। ১৪টি শ্রেণিতে (ক্যাটাগরি) এ কর্মী নেবে জাপান। তবে কর্মীদের জাপানি ভাষা জানতে হবে। জাপানের ইমিগ্রেশন বিভাগ এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, প্রথম বছর দেশটি ভিসা দেবে ৪৭ হাজার ৫৫০ জনকে।
চীন, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, মঙ্গোলিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম থেকে দীর্ঘদিন ধরেই কর্মী নিচ্ছে জাপান। এ তালিকায় নতুন করে যুক্ত হলো বাংলাদেশ।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা বাংলাদেশ কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) ইতিমধ্যেই জাপানি ভাষা প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেছে। বিএমইটির মহাপরিচালক মো. শামছুল আলম বলেন, ‘মানুষের আগ্রহ ব্যাপক। ভাষা শেখার জন্য অনেক আবেদন আসছে। কিন্তু সংখ্যা নির্দিষ্ট। অনেক ক্ষেত্রে পরীক্ষা নিয়ে বাছাই করা হচ্ছে।’
কোন শ্রেণিতে কত লোক
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে জাপান সবচেয়ে বেশি লোক নেবে নার্সিং কেয়ার শ্রেণিতে। এ সংখ্যা ৬০ হাজার। জাপানের মানুষের গড় আয়ু ৮৪ বছর হলেও ১০০ বা তার অধিক বয়সী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। বয়স্ক এসব মানুষের সেবা দেওয়ার জন্যই এ শ্রেণিতে বেশি লোক নেওয়ার চাহিদা রয়েছে দেশটির।
এ ছাড়া রেস্তোরাঁ শ্রেণিতে ৫৩ হাজার, নির্মাণ (কনস্ট্রাকশন) শ্রেণিতে ৪০ হাজার, ভবন পরিষ্কার শ্রেণিতে ৩৭ হাজার, কৃষিতে ৩৬ হাজার ৫০০, খাবার ও পানীয় শিল্প শ্রেণিতে ৩৪ হাজার, সেবা শ্রেণিতে ২২ হাজার, মেটেরিয়ালস প্রক্রিয়াজাতকরণ শ্রেণিতে ২১ হাজার ৫০০, অটোমোবাইল রক্ষণাবেক্ষণ শ্রেণিতে ২১ হাজার ৫০০, জাহাজনির্মাণে ১৩ হাজার, মৎস্যশিল্পে ৯ হাজার, শিল্প যন্ত্রপাতিতে ৭ হাজার, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিতে ৪ হাজার ৭০০ এবং এয়ারপোর্ট গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং অ্যান্ড এয়ারক্রাফট রক্ষণাবেক্ষণ শ্রেণিতে ২ হাজার ২০০ লোক নেবে জাপান।
দুই ধরনের ভিসা
লম্বা সময়ের বিবেচনায় বাংলাদেশি কর্মীদের দুই ধরনের ভিসা দেবে জাপান। ভিসা শ্রেণি-১ ও ভিসা শ্রেণি-২। ভিসা শ্রেণি-১ হচ্ছে বিশেষায়িত দক্ষ (স্পেসিফাইড স্কিলড) কর্মী ভিসা। ১৪ শ্রেণির দক্ষ কর্মীরা পাঁচ বছরের জন্য এ ভিসা পাবেন। তবে এ ভিসার আওতায় কোনো কর্মী পরিবারের কোনো সদস্য নিয়ে জাপান যেতে পারবেন না।
আর ভিসা শ্রেণি-২ হচ্ছে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য জাপানে থাকার সুবিধা পাওয়া। এই ভিসা পেলে বাংলাদেশি কর্মীরা পরিবারের সদস্যদেরও জাপানে নিয়ে যেতে পারবেন। এতে আবেদনের পূর্ব শর্ত হচ্ছে ভিসা শ্রেণি-১ থাকা। যাঁরা তাঁদের কাজের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত দক্ষতা অর্জন করতে পারবেন, তাঁরাই পাবেন এ ভিসা। অবশ্য ২০২১ সাল থেকে এই আবেদন নেওয়া শুরু হবে। সুযোগটি আবার সবার জন্য অবারিত নয়। শুধু নির্মাণ শ্রেণি ও জাহাজনির্মাণ শ্রেণিতে যাঁরা ভিসা-১ পাবেন, তাঁরাই পাবেন এ সুযোগ। পরের টানা ১০ বছর জাপানে থাকার পর দেশটিতে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতিও মিলতে পারে।
কোথায় শিখবেন জাপানি ভাষা
জাপানি ভাষা প্রশিক্ষণ না নিয়ে কেউ জাপানে যাওয়ার সুযোগ পাবেন না। বিএমইটির অধীনে ২৬টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার) চার মাস মেয়াদি জাপানি ভাষা শিক্ষার কোর্স চালু করা হয়েছে। প্রতিটিতে প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন ৪০ জন করে।
এ ছাড়া রয়েছে বেসরকারি পর্যায়ে কারিগরি ও ভাষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যেমন মিরপুর ১০ নম্বরে রয়েছে আন্তর্জাতিক ভাষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘একুশ’ (www. ekushinternationallanguagecentre. com।
বিএমইটির প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ কোরিয়া টিটিসি (মিরপুর), শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা টিটিসি (মিরপুর), বাংলাদেশ কোরিয়া টিটিসি (চট্টগ্রাম), খুলনা টিটিসি, রাজশাহী টিটিসি, রংপুর টিটিসি, পাবনা টিটিসি, রাঙামাটি টিটিসি, বান্দরবান টিটিসি, নোয়াখালী টিটিসি, ময়মনসিংহ টিটিসি, নীলফামারী টিটিসি, যশোর টিটিসি, দিনাজপুর টিটিসি, মাদারীপুর টিটিসি, নরসিংদী টিটিসি, মাগুরা টিটিসি, মৌলভীবাজার টিটিসি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ টিটিসি, কুষ্টিয়া টিটিসি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া টিটিসি, জয়পুরহাট টিটিসি, গাইবান্ধা টিটিসি, ঝিনাইদহ টিটিসি, প্রবাসীকল্যাণ ভবন (ঢাকা), জামালপুর টিটিসি ও নেত্রকোনা টিটিসি।
প্রশিক্ষণের পর পরীক্ষায় বসেন কর্মীরা। উত্তীর্ণ হলে জাপানের ব্যবস্থাপনায় আরও চার মাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এরপর শিক্ষানবিশ হিসেবে তাঁদের জাপানে নিয়ে যাওয়া হয়।
সরকারি কেন্দ্রের প্রশিক্ষণ ফি এক হাজার টাকার মতো হলেও বেসরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের চার মাসের কোর্স ফি ২০ হাজার টাকা।
একুশের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নূরুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘খরচ বেশি তবে আমরা খুব যত্নের সঙ্গে জাপানি ভাষা শেখাচ্ছি।’
বেতন কত
জাপানের শ্রম আইন অনুযায়ী একজন কর্মীর ন্যূনতম বেতন ঘণ্টায় বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭০০ টাকা। কর্মীরা দিনে ৮ ঘণ্টা কাজ করতে পারেন। সে হিসাবে একজন কর্মী মাসে পাবেন ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকার মতো। কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য সপ্তাহে ৪৪ ঘণ্টা কাজ করার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বেতনের টাকা দেওয়া হয় ব্যাংক হিসাবে।
সার্বিক বিষয়ে বিএমইটির মহাপরিচালক শামছুল আলম জানান, এ পর্যন্ত ২৮টি রিক্রুটিং এজেন্সিকে প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ জাপানে লোক পাঠানোর ব্যাপারে সহযোগিতা করতে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। টাকা নেওয়ার অভিযোগে একটির অনুমতিপত্র বাতিলও করা হয়েছে। বাকিরা কাজ করছে। জাপানি ভাষা সরকারি-বেসরকারি যেকোনো কেন্দ্র থেকে শিখলেও কোনো অসুবিধা নেই বলেও জানান তিনি।