‘বোতল বাতি’ আইডিয়াটা বাংলাদেশের কারও আবিষ্কৃত, উদ্ভাবিত বা তৈরি নয়। আইডিয়াটা ফিলিপিন ভিত্তিক আন্তর্জাতিক কমিউনিটি প্রকল্প Liter Of Light এর অংশ। বোতল দিয়ে তৈরি বাতির আইডিয়াটি পেটেন্ট করা, এবং ওপেন-সোর্স করে দেয়া আছে। অর্থাৎ যে কেউ এই আইডিয়া নিয়ে কাজ করতে পারবে, তবে এটিকে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারবেনা এবং কেউ নিজের নামে অর্থাৎ নিজেকে এটার উদ্ভাবক দাবি করতে পারবেনা।
২০১৫ সাল থেকে Lights Foundation এই বোতল বাতি নিয়ে কাজ করা শুরু করে। ২০১৭ এর এপ্রিলে Liter of Light অফিশিয়ালি লাইটস ফাউন্ডেশনের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয় নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে। লিটার অফ লাইটের প্রতিষ্ঠাতা Illac Ancellotti Diaz চুক্তিতে সই করেন। এর ফলে Liter of Light Bangladesh অফিশিয়ালি বাংলাদেশে শুরু হয়।
লিটার অফ লাইট বিশ্বে প্রায় ২০টি দেশে এক’শ এর বেশি প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হয়ে রিজিওনাল চাপ্টারের মাধ্যমে কাজ করছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে দুটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এসেছে এই ‘বোতল বাতি’ ঘিরে, যেখানে কোথাও উল্লেখ নেই ‘লিটার অফ লাইট’ এর, বরং সেসব স্বীকৃতির পর বিভিন্ন মিডিয়ায় এসছে বোতল বাতির আবিষ্কারক বা উদ্ভাবক সেই ব্যক্তি। বিষয়টা সঠিক নয়।
তার চেয়েও বড় কথা যে বোতল বাতির কথা বলা হচ্ছে সেটা বেশ কয়েকবছর আগেই ব্যবহার অযোগ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এর পর আরও ৫-১০টি ভার্সন তৈরি হয়েছে সারাবিশ্বে প্রকল্পের মধ্যে, সোলার প্যানেল, ব্যটারি, পিভিসি ইত্যাদি দিয়ে।
বিষয়টা অনেকটা এমন যে ছয় বছর আগে কেউ ৫০টা শীতবস্ত্র দিয়েছে, ৬ বছর পর তাকে সম্মাননা দেয়া হচ্ছে শীতবস্ত্র প্রদানের জনক হিসেবে।
লিটার অফ লাইট প্রকল্পটি মূলত বোতল বাতি বানানোর জন্য নয়। বরং সারাবিশ্বে বিভিন্ন চাপ্টার তাদের নিজেদের দেশের উপযোগী লাইটের ভার্সন তৈরি করে, যে লাইট পরবর্তীতে যে কেউ বানাতে পারবে।
এখানে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, ভার্সিটির ভলান্টিয়াররা কোন সুবিধাবঞ্চিত গ্রামের জন্য ৩০-৫০ টি লাইট বানায়, গ্রামে গিয়ে বিতরণ করা হয়, এবং গ্রামের মানুষকে শেখানো হয় কিভাবে এই লাইট তৈরি করা যায় সহজেই। যাতে বিদ্যুৎবঞ্চিত মানুষগুলো নিজেরাই নিজেদের সমস্যার সমাধান করতে পারে।
কোন বাজারে যদি একটা বোতল স্ট্রিট লাইট লাগানো হয়, প্রতিদিন ১০০০ মানুষ সেবা পায়, একটা স্কুলে লাগানো হলে অন্তত ৫০০ জন সেবা পায়। সংখ্যাটা বেশি হলেও লাইট কিন্তু ‘মাত্র দুটা’। এগুলো বানাতে ২ ঘন্টা লাগে। আমার দু ঘন্টার কাজের জন্য আন্তর্জাতিক সম্মাননা আমি নিবনা।
বিষয়টা খোলাসা করার ইচ্ছে ছিলনা, কিন্তু বিভিন্ন জায়গা থেকে এ বিষয়ে জানতে চাওয়াতে খোলাসা করছি।
২০১২ সালে কিছু বোতল বাতি তৈরি করেছিল নর্থ সাউথের একটা টিম। পরবর্তীতে তারা লিটার অফ লাইটের সাথে কোন কাজ করেননি। ২০১৪ তে যখন আমরা লাইটস ফাউন্ডেশন থেকে কাজ করতে চাচ্ছিলাম, প্রথম দিকে কোন সাড়া না দিলেও নর্থ সাউথের টিম পরে তাদের একটা রিসার্চ আর্টিকেল দেয়। আমি আরও বিস্তর জানার জন্য লিটার অফ লাইট পাকিস্তান, ইন্ডিয়াতে মেইল করি। এতে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে জানানো হয় আমি যদি তথ্য জানতে তাদের নক করি, তবে আমাকে ব্যান করা হবে কমিউনিটি থেকে।আমরা কাজ করলে ঐ টিমের আন্ডারে করতে হবে।
যেহেতু আইডিয়াটি ওপেন-সোর্স, কেউ কারও আন্ডারে কাজ করার কোন যুক্তি নেই, আবার কাজ করে নিজেদের নামে চালানোরও যুক্তি নেই।
২০১৫ তে প্রকল্প শুরুর পর আমাদের নিয়ে যত নিউজ আসে, সবগুলোতেই লিটার অফ লাইট, ইল্যাক ডিয়াজ, এর আবিষ্কারক আল্ফ্রেদো মোজার, সবার তথ্যই আমরা দিয়েছিলাম। যদিও লিটার অফ লাইট থেকে সে সময় কোন সহযোগিতা আসেনি।
আমরা বিশ্বাস করি আন্তর্জাতিক সম্মাননা গুলো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পরিবর্তন আনছে এমন উদ্যোগ এবং উদ্যোক্তাদের দেয়া উচিত। আর দেয়ার আগে মাঠপর্যায়ে যাচাই-বাছাই করা উচিত। আমরা ২ বছর ধরে প্রকল্প নিয়ে কাজ করেও নিজেদের এত বড় সম্মাননার ন্যুনতম যোগ্য মনে করিনা।
যাই হউক, লিটার অফ লাইট বাংলাদেশ এর একটা প্রেজেন্টেশন আছে আগামীকাল এমেরিকার নিউ ইয়র্কে। আমরা নিউজ প্রচারণা করিনি, এখন থেকে করব।
চেষ্টা করব মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনার, সেটাই আন্তর্জাতিক সম্মাননার চেয়েও অনেক বেশি পাওয়া।
লেখক: সানজিদুল আলম সেবান শান, তথ্যপ্রযুক্তি উদ্ভাবক ও সামাজিক উদ্যোক্তা