‘মন্ত্রী’ মোস্তফা জব্বারকে নিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট লিখেছেন উদ্যোক্তা ফাহিম মাসরুর। তার পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হল:
তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে দেশের সবচেয়ে পরিচিত মুখ মোস্তফা জব্বার ভাইকে সরকারের শেষ বছরে মন্ত্রী করা আসলেই একটি বড় ঘটনাI জব্বার ভাই রাজনীতিবিদ নাI তবে বর্তমান রাজনৈতিক মেরুকরণে তার নিজস্ব পক্ষ বা অবস্থানের ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট স্পষ্টI কিন্তু আমরা সবাই যা জানি বা বুঝতে পারি তা হচ্ছে তাকে মন্ত্রী করা হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে তার ভূমিকার জন্য, এবং হয়তো বর্তমান সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ভিশনে শেষ বছরে আরো গতি আনার জন্যI
অতীতে আমরা অনেক ‘টেকনোক্রেট’ (মেইনস্ট্রিম রাজনীতিবিদ বা এমপি নয়) মন্ত্রী দেখেছিI কিন্তু জব্বার ভাই-এর প্রেক্ষিত এক্ষেত্রে আলাদাI তিনি আমলা বা শিক্ষক হিসাবে পরিচিতি অর্জন করেন নিI তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন ‘একটিভিস্ট’ (সামাজিক আন্দোলনকর্মী)I তথ্য প্রযুক্তি নিয়েই তার ‘এক্টিভিজম’ I বিভিন্ন বিষয়ে তার বক্তব্য বা অবস্থান নিয়ে যে ছোটোখাটো বিতর্ক নেই, তা নয় – যেকোনো ‘একটিভিস্ট’ -এর ক্ষেত্রে সেটা থাকায় স্বাভাবিকI কিন্তু ব্যাপারটা তখনই ‘ইন্টারেস্টিং’ হয় যখন একজন ‘একটিভিস্ট’ সরকারের একটি নির্বাহী পর্যায়ে অবস্থান নেয়I সাধারণ একজন রাজনৈতিক মন্ত্রীর জবাবদিহিতা তার নেতার কাছে, তার ভোটারদের কাছে, কিন্তু একজন ‘একটিভিস্ট’ এর জবাবদিহিতা তার নিজের কাছে, যে সকল ‘দাবি’তে তিনি এতদিন আন্দোলন করেছেন, সেই ‘দাবি’ গুলোর কাছেI
তো সেই ‘দাবি’ বা ‘এজেন্ডা’ গুলো কি যা ‘একটিভিস্ট’ মোস্তফা জব্বার গত দুই দশকে করেছেন এবং দেশের সব বয়স, সব পেশার আর সব শ্রেণীর মানুষ তার সমর্থন দিয়েছেন? অনেকেই হয়তো জানেন, তারপরেও ৩টি প্রধান দাবির কথা বলা যায় যা মোস্তফা জব্বারের পরিচিতির সাথে জড়িয়ে আছে –
১/ কম খরচে ইন্টারনেট ব্রডব্যান্ডকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া –
গত কয়েক বছর এই ইস্যু নিয়ে মোস্তফা জব্বার ভাই সবচেয়ে বেশি মুখর ছিলেনI মোবাইল টেলিকম কোম্পানিগুলো শহরভিত্তিক থ্রিজি-র নামে যে ভাওতাবাজি করছে, কম দামে ব্রডব্যান্ড ‘স্পিড’ কিনে ‘ডাটা’ হিসাবে অস্বাভাবিক দামে বিক্রি করছে – সেই সচেতনতা জব্বার ভাই গড়ে তুলেছেনI এছাড়াও সারা দেশের গ্রামে গঞ্জে ইন্টারনেটের যে করুন অবস্থা, প্রতি নিয়ত তিনিই তা তুলে ধরেছেন I ব্রডব্যান্ডকে (ডাটা নয়- স্পিড) মৌলিক অধিকার হিসাবে ঘোষণা করাও তার দাবিI
২/ দেশীয় সফটওয়্যার বাজারকে বিদেশী কোম্পানিগুলোর রাহূমুক্ত করা –
বেসিসের সভাপতি হিসাবে এটি ছিল তার একটি প্রধান দাবি I একদিকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ভিশন বাস্তবায়নে দেশে হাজার হাজার কোটি টাকার সফটওয়্যার বাজার তৈরী হয়েছে, কিন্তু অন্যদিকে কাজের অভাবে অনেক দেশীয় আর তরুণ উদ্যোক্তারা কোম্পানি বন্ধ করে দিচ্ছে, কেননা বাজার দখল করছে বিদেশী কোম্পানিগুলো! এছাড়া বিদেশী টেলিকম কোম্পানিগুলোও আইন ভঙ্গ করে বিভিন্ন ডিজিটাল সার্ভিস (ভ্যাস, ই-কমার্স, মিডিয়া ইত্যাদি) ব্যবসা দখল করছেI গত কয়েক বছর বেসিস এবং অন্য (বিসিএস, BAFCOM) প্ল্যাটফর্ম-এর মাধ্যমে মোস্তফা জব্বার ভাই সরকারি বিভিন্ন ফোরামে এই বিষয়ে সরকারের জরুরি পদক্ষেপের ব্যাপারে নিরন্তন চাপ সৃষ্টি করে চলেছেন I
৩/ ডিজিটাল মিডিয়ায় বাংলা কন্টেন্টের ব্যবহার বাড়ানো
যে দেশের নব্বই শতাংশের বেশি মানুষ ইংরেজি পড়তে বা পারে না, সেই দেশে এখনো বেশির ভাগ ডিজিটাল কনটেন্ট বা সার্ভিস ‘ইংরেজি’ মাধ্যমে! দেশে সর্বস্তরে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারে সবচেয়ে বড় বাধা হিসাবে এটিকেই মনে করেন মোস্তফা জব্বারI এই সমস্যার সমাধানে বিভিন্ন পর্যায়ে সকল ‘যোগাযোগ’ ও ‘ইন্টারফেসিং’ বাংলা মাধ্যমে করার ব্যাপারে সব সময়েই সবচেয়ে সোচ্চার জব্বার ভাই I
সময় কম : সামনে পাহাড় সমান চ্যালেঞ্জ
জব্বার ভাইয়ের হাতে এক বছরের বেশি সময় নেইI এটি ভাবার কোনো কারণ নেই যে উনি যা চান তা সহজেই করতে পারবেনI সবচেয়ে বড় বাধা আসবে ‘আমলাতন্ত্র’ ও ‘ভেস্টেড ইন্টারেস্ট’ গ্রূপ থেকেI
উদাহরণ হিসাবে বলতে গেলে – ইন্টারনেটের দাম প্রান্তিক গ্রাহক পর্যায়ে কমানোর ব্যাপারে ২ টি বড় প্রতিবন্ধকতা – টেলিকম কোম্পানিগুলো কোনোভাবেই চাইবে না ‘ডাটা’ হিসাবে ইন্টারনেট বিক্রি না করে ‘স্পিড’ হিসাবে বিক্রি করতে – যা হলে তাদের মুনাফা কমে যাবে নিশ্চিত ভাবেI ঢাকার বাহিরে ব্রডব্যান্ড না যাবার আরেক প্রধান কারণ হচ্ছে ‘NTTN’ মনোপলি I মাত্র ২টি ‘NTTN’কে মনোপলি লাইসেন্স দেওয়াতে সারা দেশে ডাটা ট্রান্সফার খরচ কমানো যাচ্ছে নাI এই সকল সমস্যাই বিটিআরসি-র জানা, কিন্তু বরাবরের মতো তারা এক্ষেত্রে নীরব ভূমিকা পালন করছে!
বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল সফটওয়্যার কোম্পানি বাংলাদেশ তাদের ‘সেলস অফিস’ (তাদের কোনো ডেভেলপমেন্ট সেন্টার বাংলাদেশে নেই – বাংলাদেশ তাদের কাছে শুধুই একটা বাজার!) খুলে বসেছে – এদের নিয়মিত আনাগোনা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের করিডোরে – বড় বড় আইটি প্রজেক্ট বাগানোর জন্য সরকারি কর্তাদের বিভিন্ন সুবিধা আর নিয়মিত বিদেশ ভ্রমণের ব্যবস্থা করছে! ইতিমধ্যেই কোটি কোটি ডলারের কন্ট্রাক্ট হয়ে গেছে – আরো কিছু হবার অপেক্ষায়!
অনেক ‘ভেস্টেড ইন্টারেস্ট’ কে মোকাবেলা করতে হবে ‘মন্ত্রী’ মোস্তফা জব্বারকে ওনার ‘গণ দাবি’ আদায় করতে – নিশ্চয়ই কাজটা সহজ হবে নাI একটিকে আমলাতন্ত্র, অন্যদিকে বড় বড় বিদেশী কোম্পানি – দুই শক্তিকে সামাল দিয়েই মোস্তফা জব্বার ভাইকে তার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার যুদ্ধে নামতে হবে I
সময় কম, কাজটা অনেক কঠিনI তবে ইতিহাস সব সময় রচিত হয় অল্প সময়েই, কঠিন পরিস্থিতিতেইI সেই ইতিহাস তৈরীর আগাম অভিনন্দন জব্বার ভাইকেI