রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের জীবনাবসানের মধ্য দিয়ে ব্রিটেনে এলিজাবেথ অধ্যায়ের যবনিকাপাত ঘটল।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের পুরো নাম এলিজাবেথ আলেকজান্দ্রা মেরি উইন্ডসর। তিনি ১৯২৬ সালের ২১ এপ্রিল লন্ডনের বার্কলে স্কয়ারের কাছে একটি বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।
সবচেয়ে বেশি সময় ধরে শাসন করা ব্রিটিশ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ গতকাল বৃহস্পতিবার মারা গেছেন। গত জুন মাসে তিনি সিংহাসনে আরোহণের ৭০ বছর পূর্তি উদ্যাপন করেন। এ উপলক্ষে যুক্তরাজ্য এবং কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোতে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ৯৬ বছর বয়সের রানি এলিজাবেথ ১৯৫২ সাল থেকে টানা ৭০ বছর ধরে সিংহাসনে আসীন ছিলেন। ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের দীর্ঘ ইতিহাসে তিনিই সবচেয়ে দীর্ঘ সময় সিংহাসনে অধিষ্ঠিত থেকেছেন।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ব্রিটিশ রাজা জর্জ এবং রানি এলিজাবেথের প্রথম সন্তান। তাঁর বাবা ১৯৩৬ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। সেই সময় থেকেই এলিজাবেথ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ছিলেন। রাজকুমারী হিসেবে জীবনের প্রথম দিনগুলো পিকাডিলি, লন্ডন ও রিচমন্ড পার্কের হোয়াইট লজে পার করেন তিনি। ১৯৪০ সালে নিরাপত্তার জন্য উইন্ডসর ক্যাসেলে রাখা হয় রাজপরিবারের সদস্যদের। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়টা সেখানেই কাটে তাঁর। রাজকুমারী এলিজাবেথ এবং তাঁর ছোট বোন প্রিন্সেস মার্গারেট ওই বাড়ি থেকে লেখাপড়া করেন।
১৯৪৭ সালে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ গ্রিক ও ডেনমার্কের প্রিন্স ফিলিপকে (ডিউক অব এডিনবরা) বিয়ে করেন। ফিলিপ গত বছরের ৯ এপ্রিল ৯৯ বছর বয়সে মারা যান। এলিজাবেথ-ফিলিপ দম্পতির চার সন্তান। তাঁরা হলেন ওয়েলসের যুবরাজ চার্লস (তিনি ব্রিটেনের নতুন রাজা); প্রিন্সেস অ্যান; ইয়র্কের ডিউক যুবরাজ অ্যান্ড্রু এবং আর্ল অব ওয়েসেক্স যুবরাজ এডওয়ার্ড।
১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাবা রাজা জর্জ মারা গেলে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ সিংহাসনে বসেন এবং কমনওয়েলথের প্রধান হন। তাঁর রাজ্যাভিষেক বিশ্বজুড়ে টিভি রেকর্ড গড়ে। এ ছাড়া রাজতন্ত্র ও ব্রিটিশ কমনওয়েলথের জন্য একটি নতুন যুগের সূচনা করেন তিনি।
১৯৫০–এর দশককে রানির জন্য স্বর্ণযুগ হিসেবে দেখা যেতে পারে। রাজপরিবার ও রানির প্রতি মানুষের ব্যাপক শ্রদ্ধা ছিল। তরুণ দ্বিতীয় এলিজাবেথকে তখন রূপকথার রাজকুমারীর মতো দেখাত। তবে পরবর্তী কয়েক দশকে ব্যাপক সামাজিক পরিবর্তনের ফলে রাজতন্ত্রের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা কমতে থাকে। এ ছাড়া সম্প্রচারমাধ্যমের নতুন যুগ ও গণমাধ্যমের প্রচারের কারণে রাজপরিবারের অনেক ঘটনা সামনে চলে আসে। রানি সন্তানদের বৈবাহিক সমস্যা এবং এ–সম্পর্কিত কেলেঙ্কারির বিষয়গুলো গণমাধ্যমের শিরোনামে জায়গা করে নেয়। এরপরও মানুষ রানির কারণে রাজপরিবারের প্রতি উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন।
১৯৮১ সালে রানির বড় ছেলে প্রিন্স চার্লস এবং ডায়ানার বিয়ের বিষয়টিও মানুষের মধ্যে আলোচনার জন্ম দেয়। নব্বইয়ের দশকে প্রিন্সেস ডায়ানার প্রতি গণমাধ্যমের ব্যাপক মুগ্ধতা ছিল। ব্যাপক আলোচিত ওই দম্পতি ১৯৯২ সাল থেকে আলাদা থাকতে শুরু করেন এবং ১৯৯৬ সালে তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। ওই সময় রানি ক্রমে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যান। ১৯৯২ সালের একটি বক্তৃতায় রানি ওই বছরটিকে তাঁর জীবনের ভয়ংকর বছর বলে উল্লেখ করেন। চার্লস ও ডায়ানা দম্পতির মধ্যে কলহ রাজপরিবারের মধ্যে বিভেদ উসকে দেয়। তখন বিষয়টি গণমাধ্যমে ফলাও প্রচার পায়
১৯৯৬ সালে ডায়ানা প্যারিসে এক গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান। ডায়ানার মৃত্যুতে পতাকা অর্ধনমিত রাখতে অস্বীকৃতি জানান রানি। তখন সাধারণ মানুষ রানির প্রতি হতাশ হন। যদিও পরে রানি ডায়ানাকে প্রশংসা করলে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
২০১০ সালে জাতিসংঘের একটি বক্তৃতায় তিনি দেশগুলোকে একসঙ্গে কাজ করার গুরুত্বের কথা বলেছিলেন।
সাত দশকের বেশি সময় ধরে ব্রিটেনের সিংহাসন অলংকৃত করেছেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। নব্বইয়ের দশকে কিছু সমস্যায় পড়লেও ২০০০ সালের পরে এসে রানির জনপ্রিয়তা আবার বাড়তে থাকে। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তাঁর শাসনকালে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ রাজনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকেন।
বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজনে খ্রিষ্টান হিসেবেই তাঁর বিশ্বাসের কথা উল্লেখ করেন রানি। তবে চার্চ অব ইংল্যান্ডের প্রধান হিসেবে ভূমিকায় থাকলেও তিনি সব ধর্মের অধিকার রক্ষা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। তবে বিশ্ববাসীর কাছে রানি ছিলেন বিপুল সম্মানের পাত্র। যে দেশে তিনি সফরে গেছেন, সেখানেই পেয়েছেন রাজকীয় সম্ভাষণ। তবে জীবনের বেশির ভাগ সময় তিনি যে রাজপ্রাসাদে (লন্ডনের বাকিংহাম প্যালেস) কাটিয়েছেন, জীবনের শেষ সময়টুকু সেখানে থাকতে পারেননি। লন্ডন থেকে অনেক দূরে স্কটল্যান্ডের অ্যাবারডিনশায়ারের বালমোরাল প্যালেসে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।