গ্রহ, উপগ্রহ এমনকি ধূমকেতু অভিমুখে মহাকাশ যান পাঠানোর কথা আমরা শুনেছি। কিন্তু এবার পাঠানো হয়েছে সূর্যের দিকে, যার নাম পার্কার। উদ্দেশ্য সূর্যকে স্পর্শ করা। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা- নাসার এই যানটিই মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে প্রথম কোন স্পেইসক্রাফ্ট যা সূর্যের পরিমণ্ডলের গভীরে প্রবেশ করবে। সূর্যের পিঠে নামবে না। কিন্তু নাসার মহাকাশযান পার্কার সোলার প্রোব আর দুই থেকে চার বছরের মধ্যেই ঢুকে পড়বে সূর্যের বায়ুমণ্ডলের একেবারে বাইরের স্তর বা করোনায়। ২০২২ সালের মধ্যেই।
সূর্যের পিঠের তাপমাত্রা তেমন কিছু নয়। বড়জোর ৬ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু সূর্যের করোনার তাপমাত্রা ১০ লাখ বা তারও কিছু বেশি ডিগ্রি সেলসিয়াস। সে ক্ষেত্রে এই প্রশ্নটা ওঠা খুব স্বাভাবিক, কীভাবে ওই ভয়ংকর তাপমাত্রার হাত থেকে ‘প্রাণ’ বাঁচাবে নাসার মহাকাশযান পার্কার সোলার প্রোব?
নাসা জানিয়েছে, করোনার ওই ভয়ংকর তাপমাত্রার হাত থেকে পার্কার মহাকাশযান আর তার ভেতরে থাকা যন্ত্রাংশগুলোকে বাঁচানোর জন্য ওই মহাকাশযানে রয়েছে অত্যন্ত শক্তিশালী একটি ‘হিট শিল্ড’। সেটাই পার্কারের ‘বর্ম’ হয়ে উঠবে। তা ছাড়াও নাসার ওই মহাকাশযানে রয়েছে বিশেষ প্রযুক্তিতে বানানো স্বয়ংক্রিয় কুলিং সিস্টেমও (ঠান্ডা করার ব্যবস্থা)।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা ঠিকভাবে বুঝতে হলে আগে বুঝতে হবে তাপ (হিট) আর তাপমাত্রা (টেম্পারেচার) কী জিনিস? আর তাদের মধ্যে ফারাকটা কোথায়?
তাপ আর তাপমাত্রার ফারাক কোথায়?
কোনও কণা বা কণিকা কত জোরে (গতিবেগ) ছুটছে, তার ওপর নির্ভর করে তার তাপমাত্রার বাড়া, কমা। তাপমাত্রা আসলে ওই গতিশীল কণা বা কণিকাদের গতিবেগের পরিমাপক। আর তার ফলে মোট যে পরিমাণ শক্তির আদানপ্রদান ঘটে এক জায়গা থেকে অন্যত্র, তার মান ধরা পড়ে তাপে।
কণা বা কণিকারা খুব জোরে ছুটলে তাপমাত্রা বেশি হবে। কিন্তু সেই কণিকারা যদি সংখ্যায় অল্প হয়, তাহলে তাদের ছোটাছুটির ফলে মোট শক্তির পরিমাণও কমে যাবে। ফলে তাপ কম হবে সে ক্ষেত্রে। মহাকাশে কণা বা কণিকার সংখ্যা যেহেতু অল্পই, তাই তারা এসে ধাক্কা মারলে মহাকাশযানের গায়ের তাপ খুব বেশি বাড়িয়ে দিতে পারে না।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইসার-কলকাতা)-এর অধ্যাপক ভারতের বিশিষ্ট সৌরপদার্থবিজ্ঞানী দিব্যেন্দু নন্দী বলছেন, পার্কার সোলার প্রোব সূর্যের বায়ুমণ্ডলের যে স্তরে ঢুকবে, তার তাপমাত্রা ১০ লাখ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তারও বেশি। তবে করোনার সব জায়গার তাপমাত্রা একই রকমের নয়। তা কোথাও কম, কোথাও বেশি। একটা গরম আভেন আর ফুটন্ত পানির মধ্যে হাত ডোবালে আমাদের কী অনুভূতি হয়? আভেনের অনেক বেশি তাপমাত্রাতেও অনেক বেশি সময় ধরে হাত রেখে দিতে আমাদের ততটা অসুবিধা হয় না। কিন্তু তুলনায় কম তাপমাত্রার ফুটন্ত জলে বেশি সময় আমরা হাত ডুবিয়ে রাখতে পারি না। কারণ পানিতে কণার সংখ্যা বেশি। তাদের ছোটাছুটির ফলে বেশি পরিমাণে শক্তি এক জায়গা থেকে অন্যত্র যাচ্ছে। একইভাবে সূর্যের পিঠের চেয়ে করোনায় কণার সংখ্যা কম। ফলে করোনায় ঢোকা পার্কার মহাকাশযানকে গরম কণাদের ঝাপটা তুলনায় কম সইতে হবে। নাসা জানাচ্ছে, ওই মহাকাশযানে যে ‘হিট শিল্ড’ রয়েছে, আর তার যে দিকটা সূর্যের দিকে আছে, তাকে খুব বেশি হলে এক হাজার ৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা আড়াই হাজার ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রার ধকল সইতে হবে।
পৃথিবীতে অগ্ন্যুৎপাতে মোটামুটি ৭০০ থেকে ১ হাজার ২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ১ হাজার ৩০০ ডিগ্রি থেকে দুই হাজার ২০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রার সৃষ্টি হয়।
‘হিট শিল্ড’টা কেমন পার্কার সোলার প্রোবের?
নাসা জানাচ্ছে, ওই হিট শিল্ড বা ‘থার্মাল প্রোটেকশন সিস্টেম’ (টিপিএস)-এর ব্যাস ৮ ফুট বা প্রায় আড়াই মিটার। আর তা সাড়ে ৪ ইঞ্চি পুরু। তার ফলে, ওই হিট শিল্ডের যে দিকটি রয়েছে পার্কার মহাকাশানের দিকে, সেখানে তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৮৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি পৌঁছতে পারবে না। পার্কার মহাকাশযানের যে দিকটি থাকবে সূর্যমুখী হয়ে, হিট শিল্ড থাকবে ঠিক তার সামনে।
হিট শিল্ডটি বানিয়েছে জন্স হপকিন্স অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্স ল্যাবরেটরি। দু’টি কার্বন প্লেটের মধ্যে স্যান্ডউইচের মতো একটি কার্বন কম্পোজিট ফোম রাখা রয়েছে হিট শিল্ডে। শিল্ডের যে দিকটা থাকবে সূর্যের দিকে, সেই দিকটা সাদা সেরামিক রং-এ ‘রাঙিয়ে’ দেওয়া হয়েছে। যাতে সূর্যের তাপ যতটা সম্ভব প্রতিফলিত করতে পারে হিট শিল্ডের ‘সূর্যমুখী’ দিকটি।
নাসার গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে, হিট শিল্ড তিন হাজার ডিগ্রি ফারেনহাইট বা এক হাজার ৬৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রার ধকল সইতে পারে।
যাকে বাঁচাতে পারবে না হিট শিল্ড…
জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সোহম দাশগুপ্ত জানাচ্ছেন, পার্কার মহাকাশযানের সব প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশই যে টিপিএসের পিছনে রয়েছে, তা কিন্তু নয়। এদের অন্যতম- ‘সোলার প্রোব কাপ’। এটাকে ‘ফ্যারাডে কাপ’ও বলা হয়। সৌরবায়ুতে যে আধান (আয়ন) ও ইলেকট্রন কণিকা থাকবে, তাদের ঘনত্ব মাপবে ওই ‘কাপ’। ফলে, সৌরবায়ুর ঝাপটা তাকে সইতেই হবে। হিট শিল্ড দিয়ে তাকে বাঁচানো সম্ভব নয়। সেই সৌরবায়ুর ঝাপটা সামলাতে হিট শিল্ড বানানো হয়েছে রাসায়নিক মৌল মলিবডেনামের সংকর টাইটানিয়াম-জারকোনিয়াম-মলিবডেনাম দিয়ে। যা গলতে পারে দুই হাজার ৩৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা চার হাজার ২৬০ ডিগ্রি ফারেনহাইটে (গলনাঙ্ক)।
এ ছাড়াও পার্কার মহাকাশযানে রয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির কুলিং সিস্টেম।
তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার