প্রযুক্তি বিশ্বে হ্যাকিংয়ের ঘটনা বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ পাসওয়ার্ডে সুরক্ষিত অ্যাকাউন্টের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সচরাচর ভেঙে যেতে দেখা যায়। আবার জটিল–দুবোর্ধ্য পাসওয়ার্ড ব্যবহারকারীর জন্য মনে রাখা কষ্টকর। প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো বসে নেই। ফেসবুক, গুগল নতুন অথেনটিকেশন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিগগিরই শনাক্তকরণ টুল হিসেবে মানবদেহের ব্যবহার পাসওয়ার্ড যুগের সমাপ্তি ঘটাবে। বিভিন্ন ডিভাইস ব্যবহারকারীর নিরাপত্তা জোরদার এবং ভবিষ্যতে পাসওয়ার্ড নির্ভরশীলতা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, এমন কয়েকটি প্রযুক্তি নিয়ে আজকের আয়োজন
ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেন্সর
ফিঙ্গার প্রিন্ট স্ক্যানার যেন এখন স্মার্টফোনের অতিপরিচিত একটি ফিচার হয়ে উঠেছে। আগামী বছরের সম্ভাব্য স্মার্টফোনগুলোয় এ ফিচার আরও বেশি দেখা যাবে। অথচ মাত্র চার বছর আগে ফিঙ্গার প্রিন্ট স্ক্যানার প্রযুক্তি স্মার্টফোনে যুক্ত হয়েছিল। বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাউন্টার পয়েন্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ১০০ কোটির বেশি স্মার্টফোনে ফিঙ্গার প্রিন্ট সেন্সর যুক্ত থাকবে। আইফোন ৫ এস মডেলের সঙ্গে ফিঙ্গার প্রিন্ট স্ক্যানার এনে তা জনপ্রিয় করে মার্কিন প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান অ্যাপল। এরপর তা প্রায় সব স্মার্টফোন নির্মাতারা ব্যবহার শুরু করে। কাউন্টার পয়েন্টের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্মার্টফোন নির্মাতাদের নিরাপত্তা প্রযুক্তির একটি মান হিসেবে দাঁড়িয়ে যাবে এ প্রযুক্তি। স্যামসাং, অ্যাপল ও হুয়াওয়ে বিশ্বের প্রথম সারির তিন স্মার্টফোন নির্মাতা ফিঙ্গার প্রিন্ট প্রযুক্তি যুক্ত করছে। এ বছরে দ্বিতীয় প্রান্তিক অর্থাৎ এপ্রিল থেকে জুন এ তিন মাসে বাজারে আসা মোট স্মার্টফোনের ১২ শতাংশে ফিঙ্গার প্রিন্ট যুক্ত করেছে স্যামসাং। এরপর রয়েছে অ্যাপল (১১ শতাংশ) ও হুয়াওয়ে (৮ শতাংশ)। এখন সাশ্রয়ী দামের স্মার্টফোনেও চলে এসেছে ফিঙ্গার প্রিন্ট প্রযুক্তি।বিশ্বজুড়ে মোবাইল পেমেন্ট ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ে এ ফিচার ব্যবহার শুরু হওয়ায় ফিঙ্গার প্রিন্ট স্ক্যানারের ব্যবহার দ্রুত বাড়তে দেখা যাচ্ছে। দুই বছর আগে পর্যন্ত ফিচারটি কেবল প্রিমিয়াম স্মার্টফোনে দেখা যেত। এর কারণে স্মার্টফোনের দামের তারতম্য দেখা যেত। বর্তমানে শাওমির সাশ্রয়ী দামের ফোনেও এ প্রযুক্তি চলে এসেছে। কাউন্টার পয়েন্টের গবেষণা পরিচালক নেইল শাহ বলেন, ফিঙ্গার প্রিন্ট সেন্সরকে সহজে বোকা বানানো যায় বলে এর নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তবে সর্বশেষ হালনাগাদ ফিঙ্গার প্রিন্ট সেন্সরগুলোয় সরাসরি আঙুল শনাক্ত বা আলট্রাসনিক ফিঙ্গার প্রিন্ট বোঝার প্রযুক্তি আছে, যা আঙুলের থ্রিডি ছবি তৈরি করে। ফলে এটি এখন কিছুটা নিরাপদ হয়ে উঠেছে।
গুগল ডিভাইস
অনলাইনের প্রায় সকল সার্ভিস ব্যবহারের জন্যই পাসওয়ার্ড প্রয়োজন, তবে সেটি হাতিয়ে নেয়ার উপায় ও কম নয়। একটি ফিশিং লিঙ্কে ক্লিক, পাবলিক পিসি থেকে লগইনের সময় কি-লগারের কল্যাণে বা অন্যান্য হ্যাকের শিকার হয়ে পাসওয়ার্ড খোয়া যেতে পারে। যার জন্য টু-ফ্যাক্টর অথিন্টিকেশনের ওপর গুগল বরাবরই জোর দিয়ে আসছে। তবে সম্প্রতি বেশ বড়সড় হ্যাকের কবলে প্রচুর সেলিব্রিটি থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতারাও শিকারের পরিপ্রেক্ষিতে গুগল টু ফ্যাক্টরকে আরও সহজ করতে নিয়ে আসছে অ্যাডভান্সড প্রোটেকশন প্রোগ্রাম। যার মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা একটি বিশেষ ইউএসবি ডিভাইস তাদের কম্পিউটারে যুক্ত না করা পর্যন্ত সেটি থেকে গুগল অ্যাকাউন্ট ঢোকা যাবে না। ইউবিকি ঘরানার এই ডিভাইসটি যতক্ষণ হ্যাকারদের নাগালের বাইরে থাকবে, গুগল অ্যাকাউন্ট থাকবে সুরক্ষিত। অবশ্য টু ফ্যাক্টর অথিন্টিকেশন এখনই বাদ যাচ্ছে না। ডিভাইসটি মূলত কর্পোরেট, রাজনৈতিক ও সরকারী ব্যবহারকারীদের জন্য সরবরাহ করা হবে বলে গুগল জানিয়েছে। মূলত প্রযুক্তি ব্যবহারে অপারদর্শী ব্যবহারকারীদের জন্যই ডিভাইসটি নিয়ে গুগল কাজ করছে। জি স্যুট ধীরে ধীরে কর্পোরেট গ্রাহক পেতে শুরু করার পরিপ্রেক্ষিতেই গুগলের এই স্বিদ্ধান্ত।
ফেস অথেনটিকেশন
ব্যবহারকারীদের অ্যাকাউন্ট আরও নিরাপদ করতে এবং সুরক্ষা নিশ্চিতে ফেস রিকগনেশন প্রযুক্তি নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছে ফেসবুক। তারা বলছে, আমরা নতুন ফিচারটি নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছি। যেখানে একটি অ্যাকাউন্টের প্রকৃত মালিক তার অ্যাকাউন্ট পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার সময় দ্রুত এবং সহজে যাচাই করতে পারে। ফিচারটি শুধুমাত্র ব্যবহারকারী যে ডিভাইস থেকে ইতোমধ্যে লগইন করেছে সেখানেই কাজ করবে। এর মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট মালিকদের তাদের পরিচয় নিশ্চিত করতে পারবেন খুব সহজেই। সোশ্যাল মিডিয়া জায়ান্টটি ব্যবহারকারীদের লক অ্যাকাউন্ট পুনরায় ফেরত পেতে সাহায্য করার জন্য অনেক ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি ব্যবহারকারীকে ছবি সনাক্ত করার জন্য জিজ্ঞাসা করে, কখনোবা আবার ‘বিশ্বস্ত বন্ধু’, কখনো একটি কোড পাঠায়। এটি করা হয় ফেসবুকের কাছে আবদেন করার পর। প্রতিষ্ঠানটি একটি ভিডিও চ্যাট ডিভাইস নিয়েও পরীক্ষা চালাচ্ছে। যেটি ব্যবহারকারীদের ফেস ডিটেকশনেও কাজ করবে। ফেসবুকের প্রকল্পটির নাম আলহা। যেটি আগামী বছরের মে মাসের দিকে ডিভাইস নিয়ে সামনে হাজরি হতে পারে।
ফেস আইডি
নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আইফোন টেনে যুক্ত হয়েছে ফেস আইডি ফিচার, যা নতুন ট্রুডেপথ ক্যামেরার মাধ্যমে ব্যবহার করা হয়। এই সিস্টেমে মুখমন্ডলই হবে ব্যবহারকারীর পাসওয়ার্ড। অর্থাৎ ফোনের দিকে তাকালেই ফোন আনলক হয়ে যাবে।ফিচারটি আইফোন ৮ ও ৮ প্লাসে নেই। টাচ আইডির পরিবর্তে আইফোন টেন আনলক করতে ফেস আইডি ব্যবহৃত হবে। অ্যাপল পের মতো ফিচার ব্যবহার করতে এটি কাজে লাগবে। আইফোন টেনে যে সেন্সর, ক্যামেরা, চিপ ও ডট প্রজেক্টর আছে, তা অন্য আইফোনে নেই। এতে ব্যবহারকারীর মুখের ওপর ৩০ হাজার অদৃশ্য ডটের মাধ্যমে মুখের মানচিত্র তৈরি করা হয়, যা বিশেষ ইনফ্রারেড রশ্মির মাধ্যমে অন্ধকারের চেহারা চিনতে সাহায্য করে।
হার্ট মনিটর
মার্কিন গবেষকেরা সম্প্রতি নতুন কম্পিউটার নিরাপত্তা ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেছেন যা মানুষের হৃদযন্ত্রের আকারকেই শনাক্তকরণে উপায় হিসেবে কাজে লাগাবে। নিউইয়র্কের বাফেলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ওয়েনইয়াও ইয়ুর ভাষ্য, মানুষের হৃদযন্ত্র অন্যন্য। দুজন মানুষের হৃদযন্ত্রের আকারে কোনো মিল পাওয়া যাবে না। সাধারণত মানুষের হৃদযন্ত্রের আকার পরিবর্তন হয়না। কখনো কখনো মারাত্মক হৃদরোগ হলে তা বদলাতে পারে। পদ্ধিতটি স্মার্টফোনে ব্যবহারের পাশাপাশি বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় কাজে লাগানো যাবে। এটি নিরাপদ ও প্রচলিত পাসওয়ার্ড বা অন্যান্য বায়োমেট্রিক পদ্ধতির চেয়ে নিরাপদ। যাঁরা প্রাইভেসি বা ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় সচেতন তাঁদের কম্পিউটারে এই পদ্ধতিটি আনতে চান তাঁরা। অন্যরা যাতে কম্পিউটার লগইন করতে না পারে এজন্য এ পদ্ধতিতে কম মাত্রার ড্রপলার রাডার ব্যবহার করা হয় যা হৃদযন্ত্রে নজরদারি করে। শুরুতে হার্টস্ক্যান করতে আট সেকেন্ড সময় লাগে। এরপর সিস্টেমটি হৃদযন্ত্র শনাক্ত করতে পারে সহজেই। এটি তৈরিতে গত তিন বছর ধরে কাজ করছেন তাঁরা। হৃদযন্ত্রের আকার, গঠন ও নড়াচড়া বিশ্লেষণ করে এ পদ্ধতিটি কাজ করে।
তথ্যসূত্র: আইএএনএস, রয়টার্স, বিবিসি।