প্রতিদিনই বিশ্বব্যাপী উন্নত থেকে উন্নততর হচ্ছে প্রযুক্তি। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় প্রতিদিন বদলে যাচ্ছে দুনিয়া। সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে প্রচলিত ও প্রথাগত অনেক কিছুই। সর্বত্র কম্পিউটার আর ইন্টারনেটের হাত ধরে নিত্যদিন ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। একটি কম্পিউটার কিংবা স্মার্ট ফোন আর তার সঙ্গে ইন্টারনেট সংযোগ থাকলে বিশ্বের যে কোন জায়গায় বসেই যে কোন বিষয়ের ওপরে দক্ষতা অর্জন করা আজ মামুলি বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
তাই দেশিয় ও বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে ই-লার্নিং এখন বহুল আলোচিত বিষয়। ধরাবাঁধা শিক্ষা ব্যবস্থার বাইরে হওয়ায় ক্রমশ এবং দ্রত ই-লার্নিং এখন একটি জনপ্রিয় শিক্ষা ব্যবস্থা। দুনিয়াব্যাপী এর জয় জয়জয়কার। প্রথাগত বা প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার বাইরে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সরাসরি ক্লাশ করা কিংবা কোন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করার পদ্ধতিই হলো ইলেকট্রনিক লার্নিং বা ই-লার্নিং।
ঘরে বসে সুবিধাজনক সময়ে, পছন্দজনক বিষয়ে ই-লার্নিংয়ের মাধ্যমে সহজেই নিজেকে গড়ে তোলা সম্ভব। গতানুগতিক ক্লাশের ব্যাপার না থাকায় নিজের সুবিধামত সময়ে ই-লার্নিংয়ের মাধ্যমে শেখার কাজটি সহজেই এখন সু-সম্পন্ন করা যায়। বলা চলে আমাদের সনাতন বা প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে একেবারেই আলাদা এই ই-শিক্ষা ব্যবস্থা।
সাধারণত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থী যখন কোন একটি বিষয়ের ওপর অধ্যয়ন করেন তখন একই সময়ে অন্য বিষয়ে তাঁর শেখার সুযোগ থাকে খুব কম। অথচ অপরাপর অভ্যাস ও অধ্যয়নের পাশাপাশি কিংবা পেশাগত কাজের ফাঁকেও ই-শিক্ষা ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের অপার সুযোগ রয়েছে।
এ ব্যবস্থার সবচেয়ে সুবিধাজনক দিক হলো, নিজের ঘরে বসেই ক্লাশ করা, অভীক্ষার মুখোমুখি হওয়া এবং সনদপত্র অর্জন করা খুব সহজেই সম্ভব হয়। এ ক্ষেত্রে এখন লিন্ডা, কোর্সেরা, ইউডেমি, ইউডাসিটির মত ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্মের সুখ্যাতির কথা মানুষের মুখে মুখে ফিরছে।
২০১৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘মুক্তপাঠ’ নামক প্রথম জাতীয় ই-লার্নিং প্ল্যাটফরম উদ্বোধন করে বাংলাদেশে যুগান্তকারী ই-শিক্ষার ক্ষেত্রে এক অভিযাত্রা শুরু করেন। অল্পকাল পরেই বাংলাদেশ অর্জন করে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার World Summit on Information Society (WSIS)।
মুক্তপাঠে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মজীবী, বিদেশগামী কর্মী, প্রবাসী কর্মী, গৃহিনী, যুব সমাজ বা নবতিপর বৃদ্ধ তথা সবাই ই-লার্নিংয়ের সুযোগ পাচ্ছেন। এখানে শিক্ষকদের জন্য মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম সংশ্লিষ্ট কোর্স, বিদেশগামীদের দক্ষ করে তুলতে বিভিন্ন কোর্সসহ মোট ১৯টি কোর্স পরিচালিত হচ্ছে।
মুক্তপাঠ ছাড়াও বাংলাদেশে এখন ই-লানিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে শিক্ষক ডটকম, জাগো অনলাইন স্কুল, ব্র্যাক, ইস্টওয়েস্ট এবং এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়সহ বহু প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও বেপটো ডটকম, ইএটিএল-এর edutubebd.com, স্টাডি ডটকমসহ কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাধারণের জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রয়োজনীয় বিষয়ে ই-লানিং কোর্স চালু করেছে। বলা চলে ওয়েব বেজড লার্নিংও এখন বেশ জনপ্রিয় হয়েছে আমাদের দেশে।
অন্যদিকে ২০০২ সালে ম্যাসচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) প্রথমবারের মত ৫০টি ই-লার্নিং কোর্স চালু করেছিলো। এমআইটি-এর উদাহরণ খুব দ্রতই সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। দুনিয়াব্যাপী শুরু হয় Open Courseware Consortium. অনলাইন জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে এখন সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফরমের নাম ‘খান একাডেমি’। ২০০৬ সালে বিনামূল্যে বিশ্বমানের শিক্ষা পৃথিবীর সকল প্রান্তে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে খান একাডেমির ওয়েবসাইট চালু করা হয়। এখানে রয়েছে বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানচর্চামূলক অনুশীলন, নির্দেশনামূলক ভিডিও, ব্যক্তিগত ড্যাশবোর্ড এবং শিক্ষক সহায়িকা। খান একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশি বংশভূত সালমান খান ইতিমধ্যে ভিডিও টিউটোরিয়ালগুলো বাংলায় অনুবাদের উদ্যোগ নিয়েছেন।
বাংলা ভাষায় বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানার্জনের জন্য খুবই জনপ্রিয় ই-লার্নিং ওয়েব সাইটের নাম শিক্ষক ডটকম। প্রায় সকল বিষয়ের কোর্স থাকলেও কম্পিউটার প্রোগ্রামিং সংশ্লিষ্ট প্রচুর কোর্স রয়েছে এখানে। ফলে ঘরে বসে যে কোন বয়সের, যে কেউ নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারেন।
তবে ১০ মিনিটস স্কুল বিনামূল্যে সহজে দশ মিনিটের মধ্যেই ই-লার্নিং কার্যক্রম সম্পন্ন করে থাকে। এখানে দশ মিনিটের ছোট ছোট কুইজের ওপর পরীক্ষা নেয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে এটি প্রাপ্ত নম্বর প্রদান করে। ফলে একজন শিক্ষার্থীর মুহূর্তের মধ্যেই সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর কতটুকু দক্ষতা আছে বা কোথায় তার দুর্বলতা আছে তা জানতে পারেন এবং উপযুক্ত নির্দেশনাও এখান থেকে পেতে পারেন।
পাশাপাশি অন্য বন্ধুদের সঙ্গে তুলনা ও প্রতিতুলনা করে নিজে কতটুকু ই-শিক্ষার্থী হিসেবে এগিয়ে বা পিছিয়ে আছেন তা জানতে পারেন। ই-লার্নিং ব্যবস্থাকে শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের আওতায় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়ধীন টিচিং কোয়ালিটি ইম্প্রুভমেন্ট (TQI-II) ইন সেকেন্ডারী এডুকেশন প্রজেক্টের মাধ্যমে নবম-দশম শ্রেণির ইংরেজি, গণিত, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞানসহ বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়গুলোর অপেক্ষাকৃত জটিল অধ্যায়গুলোকে ই-লানিং ম্যাটেরিয়ালসে রূপান্তর করা হয়েছে।
উল্লিখিত ম্যাটেরিয়ালসসমূহ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (ঘঈঞই) ওয়েব সাইটে সংরক্ষিত রয়েছে যা ব্যবহার করে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং শিক্ষার যে কোন অংশীজন নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করতে পারেন। এছাড়াও TQI-II প্রকল্পের মাধ্যমে ষষ্ঠ শ্রেণীর ১৬টি বইকে Interactive Digital Textbook (IDT)-এ রূপান্তর করা হয়েছে।
পাশাপাশি সারা বাংলাদেশে ৫১টি ক্লাস্টার সেন্টার স্কুল স্থাপন করা হয়েছে যার মধ্যে ২৭টি হচ্ছে ই-লার্নিং সেন্টার। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের সেসিপ প্রকল্পের মাধ্যমেও ই-লানিং কার্যক্রম ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে। সারা বাংলাদেশে ৬৪০টি ই-লার্নিং সেন্টার স্থাপন এবং বিপুল পরিমাণ ই-লানিং ম্যাটেরিয়ালস তৈরি করেছে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ও ই-বুক প্রবর্তিত করেছে।
ই-লার্নিং ব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থীকে কখনই শিক্ষকের মুখোমুখি না হলেও চলে। তবে শিক্ষার্থী তার কৌতুহল নিবারণের জন্য কখনও ই-মেইলের মাধ্যমে বা চ্যাটিংয়ের মাধ্যমে তার জানা বা অজানার দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূর করতে পারেন। এছাড়া আলোচনার মাধ্যমে তার সহপাঠীর সঙ্গে উদ্ভূত সমস্যা শেয়ার করতে পারেন। তবে কখনও কখনও ই-লার্নিং ম্যাটেরিয়ালস পাওয়ার জন্য এবং ই-লার্নিং কোর্স সম্পন্ন করার জন্য মূল্য পরিশোধ করতে হয়।
ফলত ই-লার্নিংয়ের মাধ্যমে এখন দুনিয়াব্যাপী সাধারণ মানুষের প্রযুক্তিগত সাক্ষরতাকে শাণিত করার অপার সুযোগ রয়েছে। এর মাধ্যমে নিজেকে সমাজের যোগ্য বাসিন্দা হিসেবে গড়ে তোলা যায়। তবে ই-লার্নিং যেহেতু শতভাগ প্রযুক্তিগত শিক্ষা ব্যবস্থা সে কারণে বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষের প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য দেশের সামগ্রিক তথ্য প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর দিকে সংশ্লিষ্টদের নজর দেয়া আবশ্যক।
পাশাপাশি দেশের সর্বত্র ভাল ব্যান্ডউইথ, সহজলভ্য ও কমমূল্যে ইন্টারনেট সেবা প্রদান করা গেলে গ্লোবাল শিক্ষা ব্যবস্থায় ই-লার্নিং নতুন এক সংস্কৃতি ও চর্চার জায়গায় উপনীত হবে। মূলত বাংলাদেশের ই-লার্নিং ব্যবস্থাকে সাধারণ মানুষের মধ্যে সহজলভ্য ও জনবান্ধব করে একে দেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতির মূল অংশে পরিগণিত করতে হবে।
আর ই-লার্নিং পদ্ধতির মধ্যে যে বিপুল সোনালি সম্ভাবনার প্রযুক্তিগত সম্ভাবনা রয়েছে তাকে যথাযথ বাস্তবায়ন, রূপায়ন করা গেলে লেখাপড়ায়, পড়াশুনায়, জ্ঞান ও দক্ষতায় খুব সহজেই সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে ২০৪১ সালের উন্নত দেশের রূপকল্পখচিত আগামীর বাংলাদেশ।
লেখক: রায়হানা তসলিম, উপ-প্রকল্প পরিচালক, টিকিউআই-২ প্রকল্প, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, ঢাকা।