ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ মনে করছেন এখনকার ফেসবুক আর আগের ফেসবুক নেই। তাঁর মতের সঙ্গে অনেকেই একমত হবেন। তবে শুধু ফেসবুক নয়, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রভাব আর একচেটিয়া ব্যবসা নিয়ে কথা উঠতে শুরু করেছে। প্রশ্ন উঠছে—কে করবে দুনিয়া শাসন? নীতিনির্ধারকদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় কথা ফেসবুক-গুগলের মতো প্রতিষ্ঠান ভেঙে দেওয়ার কথাও উঠছে।
‘বিশ্ব এখন উদ্বেগ আর বিভক্তিতে ভরে গেছে। এ নিয়ে ফেসবুকের অনেক কিছু করার আছে। ফেসবুক কমিউনিটিকে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানো থেকে সুরক্ষা দেওয়া, রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের বিষয়ে ব্যক্তিকে সুরক্ষা এবং ফেসবুকে যাতে তাদের ভালো সময় কাটে, তা নিশ্চিত করা। ২০১৮ সালে আমার ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ঠিকঠাক করা।’
ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ এ বছর তাঁর পরিকল্পনার কথা এভাবেই জানান। তাঁর এ পোস্ট থেকেই তাঁর সামনের চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মূল চ্যালেঞ্জ কোনটি?
যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালির প্রযুক্তি মহিরুহ হয়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন সমালোচকদের আক্রমণের মুখে। ফেসবুক, আমাজান, অ্যাপল, নেটফ্লিক্স ও গুগলকে ঘিরে নানা বিতর্ক। প্রশ্ন উঠেছে, এসব প্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া আধিপত্য ঠেকাতে কি এগুলোকে ভেঙে দিতে হবে? টুকরো টুকরো করে ছোট কোম্পানিতে পরিণত করতে হবে?
যাঁরা এর পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন তাঁরা বলছেন, কয়েকটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের হাতে অনেক বেশি ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে রয়েছে। গত দশক ধরে কয়েকটি পশ্চিম প্রতিষ্ঠানের হাতে তথ্যের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে। তারা ব্যবসা একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে ও রাজনৈতিক নিয়মনীতির জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। তাহলে সমাধান কী? বিশ শতকে স্ট্যান্ডার্ড ওয়েল কোম্পানিকে যেভাবে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, নীতিনির্ধারকেরা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সেভাবে ভেঙে দেবেন। তবে এর বিপক্ষে কথা বলার লোকও আছেন। তাঁরা বলছেন, এসব প্রতিষ্ঠানের এমন শক্তি আছে, যা মানুষের ভাগ্য বদলে দিয়েছে। বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এনেছে গুগল ফেসবুক। লন্ডনভিত্তিক ইনটেলিজেন্স স্কয়ারড নামের একটি প্রতিষ্ঠান আয়োজিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৩৯ শতাংশ মানুষ প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে দেওয়ার পক্ষে।
২৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখার পক্ষে। তবে ৩৭ শতাংশ এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। এর আগে ২০১৬ সালের শেষের দিকে এক সমীক্ষার ফল ছিল উল্টো। অনেকেই মনে করতেন, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো পৃথিবীকে সুন্দর করে তুলছে। কিন্তু এখন? প্রযুক্তি বিশ্বের পরিচিত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে এখন বড় বড় অভিযোগ। একেকটি প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে একটি দেশের চেয়েও বড়। এতে নীতিনির্ধারকদের নেই কোনো নিয়ন্ত্রণ, প্রতিযোগিতার ধার ধারে না প্রতিষ্ঠানগুলো। একক আধিপত্য ধরে রাখা, মানুষকে আসক্ত করে ফেলা, গণতন্ত্রকে হুমকির মুখে ফেলার মতো কত অভিযোগ এখন!
শুধু কি অভিযোগেই শেষ? বিশাল দৈত্যতে পরিণত হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণের কথা উঠতে শুরু করেছে। নিয়ন্ত্রকেরা জরিমানা করছেন। রাজনীতিবিদেরা সমালোচনায় দগ্ধ করছেন। এমনকি একসময় যাঁরা এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষে উচ্চকণ্ঠে কথা বলেছেন, তাঁরাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। তাঁরা এসব প্রতিষ্ঠানের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে সতর্কবার্তা দিয়েছেন।
সম্প্রতি প্রযুক্তি বিশ্বের বড় বড় প্রতিষ্ঠানে কাজ করা সাবেক কর্মীরা মিলে ‘সেন্টার ফর হিউম্যান টেকনোলজি’ নামের একটি সংস্থা গঠনও করেছেন।
ইকোনমিস্ট-এর এক প্রতিবেদনে এসব প্রতিষ্ঠানকে ‘বিএএডিডি’ বা ব্যাড বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এর পূর্ণ রূপ হচ্ছে: বি-তে বিগ বা বড়, এ-তে অ্যান্টি কম্পিটিটিভ বা প্রতিযোগিতা বিরোধী, এ-তে অ্যাডিকটিভ বা আসক্তি সৃষ্টিকারী, ডি-তে ডেসট্রাকটিভ টু ডেমোক্রেসি বা গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর।
যে প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান মানুষের কল্যাণে কাজ করার কথা তাদের একচেটিয়া ব্যবসা ক্রেতাদের জন্য ভালো নয়, এমন মত উঠে আসছে। বিষয়টি নিয়ে নীতিনির্ধারকদের কাজ করার সময় এসে গেছে বলে মত দিচ্ছেন প্রযুক্তি বিশ্লেষকেরা।