বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি প্রযুক্তির ব্যবহারও বাড়াতে হবে। বিবাহ নিবন্ধন ফরমে জন্মনিবন্ধন সনদের নম্বর ব্যবহারের সুযোগ নেই। অনলাইনে জন্মনিবন্ধন সনদ যাচাই করে ভুয়া সনদে বিয়ে হচ্ছে কি না তা যাচাইয়ের সুযোগ রাখলে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ অনেকখানি সম্ভব হবে। একইভাবে কারখানায় শিশুদের নিযুক্ত করে কেউ যেন আইন লঙ্ঘন করতে না পারেন, সে জন্য বয়সভিত্তিক ডেটাবেজ করে শিশুশ্রম প্রতিরোধও করা সম্ভব।
গতকাল সোমবার মহাখালীতে ব্র্যাক ইন সেন্টারে ব্র্যাক সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেন। ১১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস পালন উপলক্ষে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক আয়োজিত ‘বাল্যবিবাহ এবং শিশুশ্রম রোধে প্রযুক্তির ভূমিকা’ শিরোনামে সংলাপে বক্তারা বলেন, কোভিড–১৯ টিকা নিতে সুরক্ষা অ্যাপে গণমানুষের অংশগ্রহণ প্রমাণ করেছে, প্রযুক্তি হাতের নাগালে রাখলে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তা ব্যবহার করে।
সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তবে৵ তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক জানান, ভুয়া বয়স ও প্রতারণা ঠেকাতে ‘বন্ধন’ নামে অনলাইনে বিয়ে নিবন্ধন ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে সরকার। এর সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্রের সংযোগ থাকবে। এর মাধ্যমে বাল্যবিবাহ বহুলাংশে কমানো সম্ভব হবে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রযুক্তির মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পদক্ষেপ এ সরকার আগে থেকেই নিয়েছিল বলে মহামারির সময়ে জনগণ নানাভাবে তা ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছে।
সংলাপে ব্র্যাকের জেন্ডার স্টাডিজ অ্যান্ড ডাইভারসিটি কর্মসূচির অ্যাডভোকেসি লিড তাকবির হুদা বলেন, করোনা মহামারিতে বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুসারে, ১৮ বছর বয়সের আগে ৫১ শতাংশের বেশি মেয়ের বাল্যবিবাহ হয়। ১৮ বছরের নিচের বয়সের সাড়ে ১৩ লাখ এবং ১৪ বছরের নিচের বয়সী সাড়ে ৭ লাখ কন্যাশিশু শ্রমে নিযুক্ত হয়। গৃহকর্মে নিযুক্ত কন্যাশিশুদের হিসাব এর বাইরেই রয়েছে। বিবাহ নিবন্ধন ও শ্রমিক নিয়োগের সময় অবশ্যই জন্ম সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) এবং স্কুলের সনদ যাচাই করা উচিত।
বিশেষ অতিথি ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ বলেন, বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম প্রতিরোধে আইন প্রয়োগে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অনেক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। কোভিড মহামারিতে টিকার জন্য সুরক্ষা অ্যাপ এবং তথ্য নেওয়া ও দেওয়ার জন্য ৯৯৯ জনপ্রিয় হওয়ার কারণ এ দুটি প্রযুক্তি সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে ছিল। দেশের যে সক্ষমতা রয়েছে, তার ওপর আস্থা রেখে বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম রোধেও প্রযুক্তির ব্যবহার সহজ করতে হবে।
বাল্যবিবাহ রোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা প্রক্রিয়াটি আরও সহজ করা প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করেছেন জাতীয় জরুরি সেবার দায়িত্বে থাকা পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মোহাম্মদ তবারক উল্লাহ। তাঁর বক্তবে৵ বলেন, ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার দায়িত্ব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও)। ৯৯৯ নম্বরে বাল্যবিবাহের তথ্য জানিয়ে ফোন এলেও ইউএনওর সঙ্গে সমন্বয় করা সম্ভব হয় না। অনেক সময় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা সহযোগিতা করেন না। তিনি জানান, ৯৯৯ প্রতিষ্ঠার পর ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১১ হাজার ৬৬৮টি কল এসেছে। বাল্যবিবাহের তথ্য জানিয়ে নারীর কল আসার হার ১৯ শতাংশ।
আইএলওর জাতীয় বিশেষজ্ঞ ও কর্মসূচি সমন্বয়ক সৈয়দা মুনিরা সুলতানা বলেন, শিশুশ্রম প্রতিরোধে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি শিশুকর্মীদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। একটু সমন্বয় ও ভালোবাসা দিয়ে শিশুকর্মীদের নিবন্ধিত কার্ডের মাধ্যমে সুরক্ষা দেওয়া কঠিন কোনো বিষয় নয়। বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার বয়স ও কাজের ন্যূনতম বয়সের মধ্যে সমন্বয় করা গেলে ৯৫ শতাংশ শিশুকে শ্রমের বাইরে রাখা যাবে।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নোভা আহমেদ চা–বাগান ও পোশাক কারখানায় প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে কাজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, নিজের দেশের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধান খুঁজে বের করতে নিজেদেরই গবেষণা করতে হবে। অনেক সমস্যাই এখন শনাক্ত হয়েছে, সেগুলো সমাধানের ব্যবস্থা নিতে হবে। এদেশে দুর্বলতা যেমন আছে, সক্ষমতাও আছে।
বাংলাদেশ মুসলিম নিকাহ্ রেজিস্ট্রার সমিতির সভাপতি (ঢাকা জেলা) আবদুল ওয়াহেদ বলেন, একটি শিশুর জন্ম থেকেই একটি একক নম্বরের মাধ্যমে তার তথ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। বিবাহ নিবন্ধন ফরমে জন্মসনদের নম্বর ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। সেই সুযোগ থাকলে কাজি অনলাইনে সহজে যাচাই করে নিতে পারতেন জন্মসনদটি ভুয়া কি না, অথবা ভুয়া বয়স দেখিয়ে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে কি না।
সংলাপ অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি কর্মসূচির পরিচালক নবনীতা চৌধুরী। তিনি বলেন, ডেটাবেজের বাইরে থাকার মানে হচ্ছে প্রযুক্তির বাইরে থাকা। প্রযুক্তির শক্তির সঙ্গে সমাজের প্রতে৵ক মানুষকে যুক্ত করতে হবে।