এখনো মনে আছে। মাধ্যমিক পাঠে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেছিলাম। ‘কবি ও বৈজ্ঞানিক’। কবিতার ভিত্তি হলো গিয়ে কবির কল্পনা। বিজ্ঞান ঠিক উল্টো, প্রমাণসাপেক্ষ। ‘কবি ও পুলিশ’এই শিরোনামে যদি গদ্য রচিত হয়, তবে কেমন হবে?
সেই উত্তর খোঁজার কাজে আপাতত খ্যান্ত দেই। মন দেই একটি বইয়ে। এবারের বইমেলায় প্রকাশিত একটি বই অনেকটা আকস্মিক আমার হাতে এসেছে। কবিতার বই। কবির সঙ্গে আলাপ নেই। তবে লোক মারফত তার সম্পর্কে কিছুটা জানি। তিনি যে কবিতা রচনা করেন, সে বিষয়ে অবশ্য কোনো ধারণাই ছিল না। কাব্যগ্রন্থটি তাই আমাকে অবাকই করেছে। দ্বিধাচিত্তে তাই এর পাতা উল্টাই এবং অবাক হই। পঙক্তির পর পঙক্তিতে রয়েছে অন্তহীন উপমা। রয়েছে শব্দকে নতুন ভাষ্যে উপস্থাপনের অকৃত্রিম ভঙ্গি। একটু নমুনা দেই:
প্রতিনিধি আমি তাদের,
যারা ছিল না ফাল্গুনের ভাষাবিপ্লবে,
সুর সন্তরণে, অসুর দমনে।
[ষোল কোটি বাঙালির অনুবাদ]
অমর একুশে, ভাষা আন্দোলন, ভাষাসৈনিক, ভাষাসংগ্রামী, ভাষাশহীদ, আটই ফাল্গুন- কত না শব্দে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলিতে ভরে উঠে বসন্তের প্রথম মাস। কিন্তু ‘ফাল্গুনের ভাষাবিপ্লব’ এ তো প্রচল ভাষার নবতর মাত্রা। আর ভাষাকে যিনি এভাবে ময়রার মতো ছেনে ছেনে নতুন চেহারা দিতে সক্ষম, তিনি ছাড়া কে আর কবি। তাকে কবি বলে অস্বীকার করার মতো কসুর করব না। এবং এই অবকাশে আরও এক দফা পাঠ করে নিই:
জ্যোৎস্নাকে ভাবি রাতের দারোগা;
গ্রেফতার এড়াতে পারোনি কোনো কালেই-
পারেনি তোমার স্নিগ্ধ চোখ!
পারবেও না তোমার ঠোঁট।
[গ্রেফতার]
মানবমনের চিরন্তনী চাওয়া ভিন্ন এক ব্যঞ্জনা তুলে ধরতে পারঙ্গম কবি। দেখুন আরো একবার:
আবারও তুমি সারা ভোর জুড়ে
সারা বেলায় প্রশান্ত বৃষ্টি।
ঝুঁকি নিয়ে মন্ত্র ফুঁকে দাও মেঘেদের
পল্লবিত কেশরে।
বুনটে তুলে সৃষ্টির চুমু, মীমাংসার
সুতা দিয়ে আবরণের ঘোমটা খুলে
দাও নিপুণ হাতে।
[মীমাংসার সুতা]
কবিতায় কবিতায় এভাবে প্রণয়ের পর প্রণয় উঠে এসেছে, যেখানে কেবলই লাবণ্য, কেবলই মিলন; নেই ছেদ-বিচ্ছেদ। বিরহ নেই ঠিকই, প্রণয়ের পথে থেকেও মৃত্যুর ভাবনা এড়িয়ে যান না কবি। তাই লিখে ফেলেন:
ন্যুব্জ হয়ে ওঠে নিউরন,
মৃতের ভঙ্গিমায়,
কানে এসে চুপি চুপি বলে
দেহকে জানিয়ে দেয়
কবি তোমার মৃত্যু হয়ে গেছে!
মৃত্যু হয়ে গেছে!
[গ্যালোটিনে শব্দেরা]
মানবজীবনে জরা আছে, মৃত্যুও অবশ্যম্ভাবী। তবু অমরতার পথ ধরে হাঁটার অবিরাম চেষ্টা সেই আদিকাল থেকেই আছে। এই জায়গায় এসেই অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা করে নিয়েছে মানুষ। আর দশটা প্রাণীর মতো শুধু ভোগে আর ত্যাগে তার জীবন শেষ নয়। তাই কবির আকাঙ্ক্ষা:
স্তব্ধতার যে পাশে শতায়ুরা ভিড় করে
তারা-যুগলের আত্মকথন কখনোই পিছু ফেরে না।
মিথের ধোঁয়াশার মতো লক্ষ বছরের গ্রহণে ভাসতে থাকি।
[আত্মকথন]
এই দার্শনিক ভাষণ, উপলব্ধি কবির নিজের। এই রে! কবির কথা বলছি কেবল, তার নাম নিইনি। বলিনি কাব্যখানির নামও। কবি আব্দুল্লাহ শুভ্র বিরচিত আলোচ্য এই বই ‘ফাগুন রঙা শব্দ’। কবি পরিচিতিতে নেই, অন্য উৎসে জেনেছি তিনি বাঁশিও বাজাতে পারেন বেশ। পেশাজীবনে বিসিএস পাস দিয়ে আছেন বাংলাদেশ পুলিশে। ‘কবি ও পুলিশ’প্রবন্ধ লেখবার আর কোনো দরকার আছে? কাব্যগ্রন্থটি পাঠ শেষে চূড়ান্ত রায় দিন কবিতাপ্রেমী পাঠকেরা।