আজ ৩০ ডিসেম্বর সোমবার ঢাকা প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইন্সটিটিউটের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হলো প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয়ের “গণিত অলিম্পিয়াড কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের গাণিতিক দক্ষতা বৃদ্ধির সম্ভাব্যতা যাচাই” শীর্ষক সমীক্ষা প্রকল্পের প্রকল্প সমাপনী কর্মশালা। কর্মশালার প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী জনাব মোঃ জাকির হোসেন এমপি। সভাপতিত্ব করেন মন্ত্রণালয়ের সচিব জনাব মোঃ আকরাম-আল-হোসেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সহ-সভাপতি অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. এ এফ এম মনজুর কাদির। সমাপনী কর্মশালায় অংশ নেন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, গণিত অলিম্পিয়াডের বিশেষজ্ঞগণ, দেশের সকল পিটিআই-এর সুপারিন্টেন্ডেন্ট, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও প্রকল্পভুক্ত বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ।
কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রতিমন্ত্রী মহোদয় বলেন, আমি এই প্রকল্পের পাঠদান কৌশলগুলো দেখছি, শিশুরা সহজেই গ্রহণ করবে। আগ্রহ নিয়ে করতে চাইবে। তাতে গণিত ভীতি একদম দূর হয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, আমরা ২০৪১ সালে একটি সুখী সমৃদ্ধ উন্নত জাতি হিসবে নিজেদের দেখার স্বপ্ন দেখি। আজ যে ছেলে বা মেয়েটি ক্লাস ওয়ান বা টু-তে পড়ে, ৪১ সালে তার বয়স হবে ২৬-২৭ বছর। উন্নত দেশের নেতৃত্ব দিতে হবে এই ছেলেমেয়েদেরই। আপনাদের সবার কাছে আমার অনুরোধ, আপনারা এই ছেলেম্যেদের নিজের সন্তান হিসবে দেখুন। আমাদের শিশুদের মেধা বিশ্বমানের। আনন্দের সঙ্গে শিখতে দিলে আমরাই বিশ্ব জয় করে আসবো।
বিশেষ অতিথি অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, আমরা যখন ১৭-১৮ বছর আগে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে প্রথম গণিত অলিম্পিয়াড করি, তখন ঘুণাক্ষরেও ভাবি নাই এমন দিন আসবে। আমরা ভেবেছিলাম আমাদের ছেলেমেয়েরা বিদেশে গিয়ে অলিম্পিয়াডে খুব ভাল করে আসবে। কিন্তু আজ যে উদ্যোগ গৃহীত হচ্ছে, এতে আমাদের গণিত অলিম্পিয়াডের চিন্তা দেশের প্রতিটি শিশুকে ছুঁয়ে যাবে। কল্পনাতেও আমরা এতটা আশা করি নাই। এজন্য আমি মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানাই। তিনি আরও বলেন, এই প্রকল্পের সবচাইতে ভালো দিক হলো এই পদ্ধতিটি আমাদের দেশীয় লোকদের তৈরি। আমরা সব সময় বিদেশিদের দেওয়া প্রেসক্রিপশনে কাজ করি। এখানে আমাদের দেশের মানুষেরাই সবকিছু বানিয়েছে। আমার কাছে ব্যাপারটি অত্যন্ত আনন্দের যে এমন একটা চমৎকার দিনে আমি উপস্থিত আছি। ভবিষ্যতে যখন সারাদেশে গণিত অলিম্পিয়াড পদ্ধতি ছড়িয়ে পরবে, গণিতের ভীতি দূর হয়ে যাবে, তখন আমি বলতে পারব, যেদিন কাজটি শুরু হয়েছিলো সেখানে আমিও ছিলাম। তিনি আরও বলেন, এই পদ্ধতির ফলাফল কোত্থায় গিয়ে পৌঁছুবে আমি আজ ভাবতেও পারি না।
ড. এ এফ এম মনজুর কাদির বলেন, ১৮-২০ বছর আগে গণিত অলিম্পিয়াড শুরু হয়েছিলো। আমরা সবাই দেখেছি, আমাদের দেশে এটি একটি নতুন সংযোজন। শুধু শহর নয়, গণিত অলিম্পিয়াডের সুফল গ্রামে-গঞ্জেও ছড়িয়ে পড়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমরা সেই আলো ছড়িয়ে দিতে পারছি, এটাই আমাদের আনন্দ।
বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান এই প্রকল্পের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন। তিনি বলেন, আমাদের ছেলেমেয়েরা যে পারে তা তারা বারবার প্রমাণ করে দেখিয়েছে। এই সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্পের সঙ্গে আমি নিবিড়ভাবে যুক্ত থেকেছি। আমরা চেষ্টা করেছি শিক্ষার্থীরা যাতে প্রশ্ন করে, নিজেরাই অংক করে, প্রত্যেক শিশু যাতে অংশ নেয়। আমরা দেখেছি, শিক্ষককে সুযোগ দিলে তারা করেন। অনেকে অভিযোগ করেন, প্রশিক্ষণ নিয়ে শিক্ষকরা ক্লাসে তা প্রয়োগ করেন না। কিন্তু আমি আমাদের প্রকল্পের এই ২৪০ জন শিক্ষকের ব্যাপারে তা বলতে পারব না। আমি এজন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানাই।
সভাপতির বক্তব্যে জনাব মোঃ আকরাম-আল-হোসেন বলেন, আমি গত এক বছর সচিব হিসেবে নয়, একজন ব্যক্তি হিসেবে এই প্রকল্পের সব কার্যক্রম কাছ থেকে দেখেছি। স্কুলে গিয়েও দেখেছি। এই প্রকল্পের পদ্ধতিগুলোতে শিক্ষার্থীরা যেভাবে গণিত শেখে তা দেখে আমি নিশ্চিত হয়েছি, এই পদ্ধতিতেই গণিতের ভীতি দূর হবে। পরিকল্পনা ছিলো এই পদ্ধতি ২১ সাল থেকে সারাদেশে চালু হবে। কিন্তু আমি চেয়েছি, এমন চমৎকার একটি কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে। শুধু স্বপ্নই দেখি নাই, স্বপ্ন বাস্তবায়ন যাতে হয় সেজন্য সারা দেশে এই প্রকল্প ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ এক বছর এগিয়ে এনেছি। মুজিব বর্ষকে উপলক্ষ করে ২০২০ সালেই এই পদ্ধতি আমরা সারাদেশে চালু করতে যাচ্ছি। আমি নিশ্চিত, আমাদের এই কার্যক্রম সবার কাছে নিয়ে যেতে পারলে ২০৪১ সালে সমৃদ্ধ, উন্নত ও মেধাসম্পন্ন জাতি গঠন সম্ভব হবে।
অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রকল্প পরিচালক জনাব মোঃ নূরুন্নবী স্বাগত বক্তব্যে জানান, এই প্রকল্পের আওতায় গণিত অলিম্পিয়াডের দর্শন অনুসরণ করে ১ম-৪র্থ শ্রেণির গণিত পাঠদান পদ্ধতি তৈরি করা হয়েছে। গত বছরের শেষ ভাগ থেকে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের আওয়াতায় ১৭ জেলার ১৭ টি উপজেলা থেকে ৮০ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২৪০ জন শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ৫, ৪ ও ৩ দিনের তিনদফার এই প্রশিক্ষণ শেষে শিক্ষকগণ নিজ নিজ স্কুলে ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণিতে গণিত অলিম্পিয়াড পদ্ধতিতে পাঠদান করেন। সবাইকে যুক্ত করতে প্রকল্পের উপজেলাগুলতে আয়োজন করা হয় অবহিতকরণ কর্মশালা। বছরের শেষে এসে ১৭ উপজেলায় আয়োজন করা হয় প্রাথমিক গণিত অলিম্পিয়াড। যারা সরাসরি জাতীয় গণিত অলিম্পিয়াডের বিভাগীয় পর্যায়ে অংশ নেবে।
কর্মশালার পাশাপাশি ছিল গণিত অলিম্পিয়াড পদ্ধতির একটি নমুনা প্রদর্শনী। সমীক্ষা প্রকল্পে প্রশিক্ষিত ১০ জন শিক্ষক এই প্রদর্শনীতে এই পাঠদান পদ্ধতির নানা দিক তুলে ধরেন।
উল্লেখ্য, প্রকল্পটির ফলাফল সন্তোষজনক হওয়ায় ইতোমধ্যে এই প্রকল্পে তৈরি করা পাঠদান পদ্ধতি সারাদেশের ৬৫ হাজার স্কুলে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রাইমারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম ফোরের একটি সাব-কম্পোনেন্ট গ্রহণ করেছে। “গণিত অলিম্পিয়াড পদ্ধতিতে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের (১ম-৫ম) গাণিতিক দক্ষতা উন্নয়ন” নামে এই সাব-কম্পোনেন্টের আওতায় ইতোমধ্যে ৯০ জন রিসোর্স পারসন প্রশিক্ষিত হয়েছেন। যারা সারাদেশে প্রায় ৩ হাজার মাস্টার ট্রেইনারকে প্রশিক্ষণ দিবেন। মাস্টার ট্রেইনারদের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ গণিত অলিম্পিয়াড পদ্ধতির প্রশিক্ষণ পাবেন।