ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংসদে পাস হলে বিতর্কিত ৫৭ ধারা বাতিল হয়ে যাবে। ডিজিটাল অপরাধ ঠেকাতেই এ আইন করা হচ্ছে। আজ শনিবার সকালে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনে (বিএফডিসি) ‘ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি আয়োজিত এক ছায়া সংসদ বিতর্ক প্রতিযোগিতার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মন্ত্রী এসব কথা বলেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হলে বিতর্কিত ৫৭ ধারা থাকবে না জানিয়ে মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘এখনো তাৎক্ষণিকভাবে মামলা হলেই তাঁকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া এই ব্যবস্থাটি প্রচলিত নয়। প্রথম সুসংবাদটা আমি দিতে চাই, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ৫৭ ধারা বিলুপ্ত হবে। অতএব এই ধারা প্রয়োগ করার আর কোনো সুযোগ থাকবে না। তবে বিগত দিনে ৫৭ ধারায় যত মামলা হয়েছে তা ওই আইনের আলোকেই বিচার হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘ডিজিটাল অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে বিষয়টিকে আইনি কাঠামোর মধ্যে অবশ্যই আনতে হবে। এই আইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতে প্রণীত হচ্ছে না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে জনগণের বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কিছুই এ আইনে বাধা হবে না। ডিজিটাল অপরাধ নিয়ন্ত্রণই এই আইনের মূল লক্ষ্য। আগে ডিজিটাল অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য ৫৭ ধারা ছাড়া কোনো আইন বিরাজ করছিল না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হলে ৫৭ ধারা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বিতর্কিত ৩২ ধারাতে গুপ্তচর বিষয়টি উল্লেখ ছিল। বর্তমানে সেটা রাখা হয়নি। রাষ্ট্রীয় গোপন কোনো তথ্য প্রচার করলে অপরাধ হবে। কিন্তু সরকারি কোনো তথ্য উপাত্ত প্রচার বা প্রকাশ করা হলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।’
মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সাইবার আইনসহ এ বিষয়ে বিভিন্ন আইন থাকলেও কোথাও ডিজিটাল আইনের অস্তিত্ব নেই। শুধু বাংলাদেশেই প্রথম এই আইন হচ্ছে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়ে গুজব নিয়ন্ত্রণে এ জাতীয় আইনের প্রয়োগ জরুরি ছিল।’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও ৫৭ ধারার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। শুধু ধারা দুটির শাস্তির বিধানে কিছু পার্থক্য রয়েছে।
এই আইনের যে খসড়া তৈরি করা হয়েছে, তার ১৯ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা, অশ্লীল এবং যা মানুষের মনকে বিকৃত ও দূষিত করে, মর্যাদাহানি ঘটায় বা সামাজিকভাব হেয়প্রতিপন্ন করে; অথবা কেউ যদি স্বেচ্ছায় কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার উদ্দেশে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন যা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পাঠ করলে বা দেখলে বা শুনলে তা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে, তাহলে তিনি অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন অথবা দুই লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
এ ছাড়া কোনো ব্যক্তি যদি ইলেকট্রনিক মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা আদালত কর্তৃক মীমাংসিত মু্ক্তিযুদ্ধের বিষয়াবলী বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে প্রপাগাণ্ডা, প্রচারণা বা তাতে মদদ দেয়, তাহলে তার শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড অথবা তিনি উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। এ রকম বিধান রেখে প্রণয়ন করা হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন।
পার্থক্য হলো, ৫৭ ধারার তুলনায় ১৯ ধারায় শাস্তির পরিমাণ কম। ৫৭ ধারায় কেউ অপরাধ করলে তার অনধিক ১৪ বছর এবং অন্যূন সাত বছর কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। পাশাপাশি এটি জামিন অযোগ্য। পক্ষান্তরে নতুন আইনের ১৯ ধারায় কেউ অপরাধ করলেও সেটি জামিনযোগ্য।
নতুন এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ধারা রহিত হবে এবং এই ধারাগুলোর অধীনে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা নতুন এই আইনের অধীনে নেওয়া হয়েছে বলে গণ্য হবে।
মানুষকে ডিজিটাল অপরাধ থেকে নিরাপদ রাখতে আইসিটি বিভাগ থেকে প্রকল্প তৈরি করা হচ্ছে। এই প্রকল্প ডিজিটাল অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে জানান মোস্তাফা জব্বার।
অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, ‘ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউবসহ অন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বর্তমান বিশ্বে মানুষের জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। জনমত গঠন, তথ্যের আদান প্রদান, সচেতনতা তৈরি, বিনোদন এমনকি বিষণ্ণতা কাটাতেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন সকল বয়সী মানুষের নিত্যসঙ্গী। তবে, এই যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণই এখন আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ।’ তিনি বলেন, ‘তুচ্ছ ঘটনাকে অতিরঞ্জিত করে, চটকদার ছবি দিয়ে অপপ্রচার চালানো কিংবা কাউকে হেয় করে কোনো সংবাদ ছড়িয়ে দেওয়া এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ফলে বিশ্বাস-ভালোবাসা, মূল্যবোধ, পারিবারিক বন্ধন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা তৈরি হচ্ছে। তাই এই যোগাযোগ মাধ্যমের বেআইনি ব্যবহারের বিরুদ্ধে আইনি নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। তবে আবার খেয়াল রাখতে হবে যাতে এ ধরনের আইনি নিয়ন্ত্রণ মৌলিক চেতনার পরিপন্থী না হয়ে মুক্ত সাংবাদিকতা বা মত প্রকাশকে সংকুচিত না করে। এ ক্ষেত্রে আইসিটি অ্যাক্ট এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এর দুটি ধারা নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে তা নিস্পত্তি হওয়া প্রয়োজন।’
হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণের সঞ্চালনায় এই বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয় বিরোধী দল হিসেবে অংশ নেওয়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। আর সরকারি দল হিসেবে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি।